৯ জুন ২০১৮, শনিবার, ৮:১৪

বাজেটে উপেক্ষিত সাধারণ মানুষ

ড. আর এম দেবনাথ
বাজেট বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না রেখেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য আবার এক বিশাল বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এ বাজেটে খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আয় ধরা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ঘাটতি হল কত? ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। জিডিপির তুলনায় এর পরিমাণ ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট খরচে ভর্তি, আয়ে নয়। তিনি বরাবর এ কাজটি করে যাচ্ছেন। বিশাল খরচ তার লক্ষ্য। একেই বলা হচ্ছে স্মরণকালের বৃহত্তম বাজেট। মিডিয়া দেখছি এই কথাই বলে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রকৃত খরচ ছিল মাত্র ২ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থছরে এ খরচ বেড়ে হবে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। বিশাল ঘটনা। আয় সেভাবে বাড়ছে না, অথচ খরচ ভীষণভাবে বাড়ছে। এতে সবারই আশঙ্কা, সরকারি খরচের গুণগত মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই এক টাকার কাজ দেড় টাকা-দুই টাকায় করা হচ্ছে। এটা অর্থনীতির জন্য একটা বড় ক্ষত। কারণ আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পথ খুব বেশি খোলা নয়, সেখানে ব্যয়ের গুণগত মান থাকা দরকার শতভাগ। কিন্তু এ বিষয়টিই হচ্ছে না। এটা আমাদের বাজেট প্রক্রিয়ার বড় দুর্বল দিক।

আয়ের দিকে যদি আসি তাহলে দেখা যায় এবারও অর্থমন্ত্রী বরাবরের পথই ধরেছেন। তার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে পরোক্ষ করের দিকেই অথচ মুখে বলা হচ্ছে প্রত্যক্ষ করের কথা। ভ্যাট একটা পরোক্ষ কর, যা সবাইকে- ধনী ও দরিদ্রকে- একই হারে দিতে হয়। এর প্রতি ঝোঁক লক্ষণীয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে। বাজেটের রাজস্বের জন্য আরেক নির্ভরশীলতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে উৎসে কর কর্তন, উৎসে আয়কর কর্তন। এ কাজটা সহজ এবং এখানেও করের ন্যায্যনীতি উপেক্ষিত। দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী আগেও যেমন গরিব ও মধ্যবিত্তের কাছ থেকে বেশি বেশি রাজস্ব আদায় করেছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও তিনি তা-ই করবেন। এবারের উদাহরণ তো আরও প্রকট। তিনি সাধারণ করদাতাদের আয়কর হ্রাসের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। গত বছরও করেননি, এর আগের বছরও করেননি। অথচ মূল্যস্ফীতি কিন্তু বাড়ছে। সরকারই বলছে, এবার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশ হবে। এতদসত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের একটি পয়সাও ছাড় দিলেন না। স্ল্যাব বা স্তরভেদে যে করহার ছিল তা-ই রাখা হয়েছে। সারচার্জের ক্ষেত্রেও তা-ই। সেখানেও তিনি বাড়িঘর-সম্পত্তির মালিকদের সারচার্জের আওতায় আনতে পারলেন না। এটা চালু করা হয়েছিল ‘সম্পদ কর’ হিসেবে। অথচ এখন চালু হয়েছে সারচার্জ হিসেবে। লক্ষণীয়, তিনি এসবে কোনো পরিবর্তন না আনলেও ব্যাংক মালিকদের রেয়াত দিলেন। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ২০১৩ সালে অনুমোদিত ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি করহার তিনি আড়াই শতাংশ কমালেন। এর আগে এদের অনেক সুবিধা বাজেটের বাইরেও তিনি দিয়েছেন। বলা যায়, নজিরবিহীনভাবে। তাদের বেলায় সিআরআর হ্রাস করেছেন, পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন। সরাসরি আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন। অথচ এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানুষ উত্তেজিত। এতদসত্ত্বেও কেন জানি অর্থমন্ত্রী ব্যাংক মালিকদের প্রতি খুবই সদয়। ঠিক আছে, কিছুটা খাতির কি ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের তিনি করতে পারতেন না? এসব পদক্ষেপের ফলে যে দেশে বৈষম্য বাড়ছে তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না? এ মুহূর্তে দেশের ১০০ টাকা আয়ের মধ্যে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ লোক পায় মাত্র এক টাকা। আর টপ ধনীদের ১০ শতাংশ পায় প্রায় ৩৯ টাকা। এ বৈষম্য যে তার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একসময়ে কমাবে তা তিনি বুঝতে পারছেন কি?
আসা যাক বরাদ্দের ক্ষেত্রে। এটাও খরচের দিক। দেখা যাচ্ছে তিনি ধার-কর্জ করে যে খরচ বাড়াচ্ছেন তাতেও কোনো যুক্তি নেই। গেল অর্থবছরে হঠাৎ করে তিনি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করেছেন। অথচ দক্ষতা, জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা তিনি করছেন না। এবারের নতুন বাজেটে বরাদ্দের চিত্রটি বড়ই করুণ। দাবি করা হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বিচারে কী ঘটছে? হিসাবটা হবে জিডিপির অনুপাতে অথবা সমগ্র বাজেটের ভিত্তিতে। আজ থেকে ৫-৬ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য সমগ্র বাজেটে বরাদ্দ ছিল মোট খরচের ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা মাত্র ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় এ সময়ে বরাদ্দ ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।

ভাবা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ হ্রাসের ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তারা পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বরাদ্দ। মজার ঘটনা হচ্ছে, বাইরে অনেক অর্থনীতিবিদ হইচই করছেন যে, সরকারের সুদ খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে, অথচ তথ্যে দেখা যাচ্ছে সমগ্র বাজেটে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা মাত্র ১১ শমিক ০৫ শতাংশ। এর থেকে অহেতুক হইচই বন্ধ হওয়া উচিত নয় কি?
বাজেট ডকুমেন্টটি পড়লে বোঝা যায় এর বিরাট অংশেই রয়েছে সরকারের অগ্রগতির হিসাব। কোথাও ১০ বছরের হিসাব, কোথাও বিগত বছরের হিসাব। হিসাবটি আশাব্যঞ্জক। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮০। এর জন্য বিনিয়োগ দরকার। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা ভালো নয়। ২২-২৩ শতাংশে এসে তা স্থবির হয়ে পড়েছে।

অথচ অর্থমন্ত্রী বলছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা হবে ২৫ দশমিক ১৫ ভাগ। কীভাবে? বাজেটে তো এর জন্য খুব বেশি পদক্ষেপ দেখলাম না। কর্পোরেট ট্যাক্স মানে ব্যাংক-বীমার ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এতে কি বিনিয়োগ বাড়বে? ব্যাংকগুলো থেকে প্রচুর ঋণ দেয়া হচ্ছে। আমানতের বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের বৃদ্ধি অনেক বেশি। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগের চিত্র খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
আরেকটি বিষয়, যা উল্লেখ করতেই হয়। সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয়েছে সোয়া ৭ শতাংশের ওপর। কিন্তু কর্মসংস্থানের তথ্য তো মেলানো যাচ্ছে না। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কর্মচ্যুতি ঘটছে। নারী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি ঘটছে। সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের তথ্য মেলানো খুবই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে জোরালো কোনো পদক্ষেপের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে অর্থমন্ত্রী কয়েকটা কাজ করেছেন। তিনি দেশীয় কিছু শিল্পকে সংরক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

ওষুধ শিল্প, চামড়া শিল্প, টেক্সটাইল, লৌহ ও ইস্পাত, গুঁড়োদুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, রেফ্রিজারেটর ও কমপ্রেসার শিল্প, মুদ্রণ শিল্প, ইলেকট্রিক পণ্য ইত্যাদিকে তিনি বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বলাবাহুল্য, এর মধ্যে অনেকগুলো খাতের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল বলে অনেকে মনে করেন। আইসিটি শিল্পও কিছু সুবিধা পেয়েছে। কৃষি খাতের প্রধান উপকরণ সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আমদানিতে শূন্য শুল্কহার অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

চাল আমদানিতে রেয়াত সুবিধা প্রত্যাহার করার ফলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পেতে অসুবিধা হবে না। গম, ভুট্টা, আলু ও কাসাভা উৎপাদনে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য ডিউটি বসানো হয়েছে। ট্যারিফ মূল্য তিনি যৌক্তিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে। এ ট্যারিফ মূল্যের কারণে দেশীয় ক্রেতাদের পণ্যের মূল্য অহেতুক অনেক বেশি দিতে হয়। এটা এবার কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রে তিনি কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রতিযোগিতা থেকে দেশীয় শিল্পকে রক্ষার জন্যই এ ব্যবস্থা। এতে এনার্জি ড্রিংক, প্রসাধনী সামগ্রী, শেভিংয়ের আগে পরে ব্যবহৃত সামগ্রী, সিরামিক বাথটাব ইত্যাদি পণ্যে দেশীয় শিল্প কিছুটা সুরক্ষা পাবে বলে মনে হয়। এভাবে বিচার করলে দেখা যায় অর্থমন্ত্রী ব্যবসাবান্ধব, ব্যবসায়ীবান্ধব একটা বাজেট দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি তার চিরায়ত পথে থেকেই তা করেছেন।

অবশ্য স্বীকারও করেছেন, আগামী দিনে ন্যায্যতা ও সাম্যের দিকে নজর দিতে হবে। বৈষম্য দূর করতে হবে। সরকারের পারফরম্যান্সের দিকে আর গেলাম না। দৃশ্যতই এসব পারফরম্যান্স বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত। তা হওয়ারই কথা। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, মাতৃমৃত্যু হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতি খুবই ভালো করছে। তবে এ মুহূর্তে নজর দেয়ার মতো ইস্যু অনেক। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি, নিু কর্মসংস্থান, কর্মচ্যুতি, বিশৃঙ্খল আর্থিক খাত, নিু রাজস্ব আয় স্তর, বেকারত্ব ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট।
বাজেট এক বছরের জন্য। নির্বাচন ২০১৮ সালের শেষে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় এটা। সরকারকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল একসময়ে ৯৭-৯৮ শতাংশ। তা এখন থেমেছে ৮০-এর নিচে। সাবধান হওয়া ছাড়া গতি নেই।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/57885