৮ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৪

ধান ভাঙলে কুঁড়ো দেব......

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা: ‘ধান ভাঙলে কুঁড়ো দেব, মাছ কাটলে মুড়ো দেব; কালো গাইয়ের দুধ দেব.....’ যদিও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসব কথা খুব এটা শোনা যায় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ঘটনা প্রবাহ এসব কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে অতীতটা একেবারে বিস্মৃত হতে হয় না এটাই আমাদের প্রাপ্তি। আসলে আমরা শৈশবে মুরব্বীদের মুখে অনেক ছেলে ভোনানো ছড়া শুনে পুলকিত ও রোমাঞ্চিতও হয়েছি। এসব ছড়ার মাধ্যমে শিশুদেরকে আকর্ষণীয় বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করা হতো কিন্তু তার কোনটাই আবার শর্তহীন ছিল না। কিন্তু শিশুমন তা উপলব্ধি করতে পারে না বলে সহজেই প্রভাবিত হতো। আর এটিই ছিল সে সময়ের মুরব্বীদের বিশেষ অর্জন।

শর্তহীন নয় এই জন্যই বলছি যে, যদি ধান ভাঙা হয় তাহলে ভাগ্যে কুড়ো জুটবে, আর যদি মাছ কাটা হয় তাহলেই মুড়োটা পাওয়া যেতে পারে। দুধ যখন তখন মিলবে না কালো গাইয়ের প্রাপ্তি ছাড়া। আসলে ছেলে ভোলানো ছড়া বলে কথা। অবশ্য ইদানীংকালে ছেলেরা এসব কথায় আর ভোলে না। তারাও এখন রীতিমত বুদ্ধিমান ও চৌকস হয়ে উঠেছে। এখন অতি শৈশবকাল থেকে তাদের মধ্যে বেশ বুদ্ধিমত্তা লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় তাদের বুদ্ধির কাছে অনেক বড় মানুষকেও হার মানতে হয়। আমিও আমার মেয়ের কাছেই খুব একটা সুবিধা করতে পারি না। হাতে-পায়ে বেশ ছোট হলেও সে মাঝে মাঝে আমার জ্ঞান-গরিমা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বসে। মনে হয় বিশাল এক মহিরূহ। তাই একদিন অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমার কানে ভেসে এলো, ‘আম্মু আব্বু স্মার্টফোনের কিছুই বোঝে না’। আমার তো একেবারে আক্কেল গুড়–ম অবস্থা। ডিজিটাল যুগের মেয়ে বলে কথা। আর আমি তো সেই এনালগ যুগের কাকভূষন্ডি।

আমার স্মার্টফোন দিয়ে কি করা যায় এনিয়ে কখনো গবেষণা করি নি। তবে মেয়ের কথা শুনে মনে হলো আমি যা করি তার চেয়ে আরও বেশি কিছু করার সুযোগ আছে। কিন্তু আমার স্বল্প বুদ্ধিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি। মেয়ের মুন্সীয়ানা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু কুলকিনারা হয়নি। উপায়ন্তর না দেখে একদিন আমার বাল্যবন্ধুকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই একেবারে অট্টহাসিতে অট্টালিকা ফাটিয়ে বসলো। পরে অনেকটা বেরসিকের মতই যা বলে বসলো তার নির্যাসটা হলো ওদের রূহের (আত্মা) বয়স হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা সকল জীবাত্মাকে এক সাথেই সৃষ্টি করেছে। ওরা শুধু এই নশ^র ধরাধামে দেরিতে এসেছে (খধঃব পড়সবৎ) তফাৎটা শুধু এখানেই।
এখন আর ছেলে ভোলানো ছড়া মুরব্বীদের মুখে শোনা যায় না। আগের দিনে তা শুধু শিশুদের ভুলিয়ে রাখার জন্য বলা হতো এমন নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে তা আর অবশিষ্ট নেই। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও রুচীবোধে পরিবর্তন এসেছে। বিনোদন জগতেও আধুনিকতার পালে হাওয়া লেখেছে। মানুষ আর সনাতনী যুগের জারি, সারি, ভাটিয়ালি, সোনাভানের পুঁথি ও রূপকথার গল্পকে বিনোদনের মাধ্যমে হিসেবে মনে করে না বরং আকাশ সংস্কৃতির জয়জয়কার আমাদের মনমেজাজকে অনেকটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সুস্থ্যধারার বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে কদাকার জাতীয় বিনোদন ও সংস্কৃতি। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদেরকে এখন কিভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করা যায়, মানুষের মধ্যে কীভাবে গৃহবিবাদ সৃষ্টি করে মধ্যস্বত্বভোগ করা যায় তাই হয়েছে আমাদের আত্মবিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম। ফলে আমাদের ঘাড়ে যে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব চেপে বসেছে তা মোটামোটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর ঢেউটা লেগেছে সর্বত্রই।

আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক ও সামাজিক জীবন থেকে ছেলে ভোলানো ছড়া হারিয়ে গেলেও তা এখন অন্য জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। বুড়োবুড়িদের বলয় থেকে বেড়িয়ে তা এখন রীতিমত রাজনৈতিক চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছে। এক শ্রেণির রাজনীতিকরা দেশের মানুষকে কচি খোকা ভাবতে বেশ পুলকবোধ করেন। মনে হয় তারাই সবকিছু বোঝেন। তাই দেশে কোন নির্বাচন এলেই তারা ছেলে ভোলানো ছড়ার পসরা এসে হাজির হয়। জুন মাসে এলেই অর্থমন্ত্রীর মাথা আর ঠিক থাকে না। কখন কাকে কী বলে বসেন এই নিয়ে আমাদেরকে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। মূলত দেশে নির্বাচন এলেই রাজনীতিকদের মুখ একেবারে লাগামহীন হয়ে পড়ে। প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ফুলঝুড়ি শোনা যায় তাদের মুখে মুখে। ১০ টাকায় চাল, ঘরে ঘরে চাকুরি, বিনামূল্যে সার, ডিজিটাল রাষ্ট্র আর কত সব ছেলে ভোলানো ছড়া আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা শুনিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতায় একেবারে অশ^ডিম্ব। কারণ, তাদের কথা, কাজ ও আন্তরিকতার মধ্যে থাকে বিস্তর পার্থক্য।

বাস্তবতা হচ্ছে, ১০ টাকায় আমাদের দেশে আর কোন চালই পাওয়া যায় না। ঘরে ঘরে চাকরি হওয়ার পরিবর্তে চাকরিচ্যুতির অভিযোগটাও বেশ প্রবল। নির্বাচনের আগে বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণের কথা বলা হলেও বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, বিগত বছরগুলোতে বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণের পরিবর্তে সঙ্কোচিত হতে হতে এখন তা প্রান্তিক পর্যায়ে এসেছে। ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে রীতিমত ভাটির টান পড়েছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিনামূল্যে সার তো দূরের কথা টাকা দিয়েও সার এখনও সহজলভ্য হয়ে উঠেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশে শুরু হয়েছে রীতিমত ডিজিটাল প্রতারণা। আইনের শাসনের পরিবর্তে চলছে আইন অমান্যের মহড়া। আইন সবার জন্য সমান একথা আর কার্যকর নেই বরং আইন যে ব্যক্তি বিশেষে ভিন্নতর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সে কথায় বারবার আলোচনায় এসেছে। যা জনজীবনকে রীতিমত দুর্বিষহ করে তুলেছে।
দেশ এখন অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো দুষ্টের দমন করে শিষ্টের লালন করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মত। খুব সঙ্গত কারণেই অপরাধ দমনের নামে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। এখানেও কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাম করে দেশের মানুষকে শোনানো হচ্ছে ছেলে ভোলানো ছড়া। আমরা আগে শুনতাম সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করে। এখন শুনছি গঞ্জিকা ও হিরোহোইন সেবীরাও আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদদারি ও ব্যবহার বিধি রপ্ত করে ফেলেছে। তাই র্যা বের মত এলিট ফোর্সের বিরুদ্ধেও বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে এসব গন্তব্যহীন পথিকরা। শোনা যাচ্ছে ঈদের পরে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বন্দুক যুদ্ধের মত ঘটনা ঘটে কি না তা দেখতে অবশ্য আমাদেরকে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সম্প্রতি একথাও শোনা যাচ্ছে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করলে নাকি গোটা দেশকে একেবারে স্বর্গ বানিয়ে দেয়া হবে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় রাজনীতিকরা ক্ষমতার ধারাবাহিকতার কথা বলে নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার দিবাস্বপ্নে বিভোর। আসলে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় যদি জাতীয় উন্নয়নের মানদন্ড হয় তাহলে সংবিধানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না বরং এর পরিবর্তে ক্ষমতার ধারাবাহিকতার অনুকুলে নতুন কিছু সংযুক্ত হওয়ায় তো অধিক যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। মূলত রাজনীতিকদের এসব ছেলে ভোলানো ছড়ায় বারবার বিভ্রান্ত হচ্ছে। মানুষ যতবারই এসব কথা বিশ^াস করেছে ততবারই বিশ^াস ভঙ্গের মত দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কারণ, এসব গালগল্পের সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক থাকে না বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্যই এসব অশুভ চর্চার আশ্রয় নেয়া হয়। যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়।

রাজনৈতিকরা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েই দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে এমন নয় বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে রীতিমত প্রতারিত করা হয়েছে। কথিত সমুদ্র বিজয়ের নামে আমরা আমাদের সমুদ্রসীমার অনেক অংশই হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি বহুল আলোচিত তালপট্টি দ্বীপ শুধু আমারা হারিয়েই বসিনি বরং একশ্রেণির গলাবাজরা তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। হয়তো এমন দিন আসবে তখন এসব বিভিষণরা বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসবে। এমন দুঃখজনক ঘটনায় গলাবাজরা লজ্জা না পেলেও লজ্জা পেয়েছেন এদেশের আত্মসচেতন মানুষ। এরপরও আমাদেরকে সমুদ্র বিজয়ের উপাখ্যান শুনে প্রীত হতে হচ্ছে। কারণ, হবুচন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন কিছুইতেই অসন্তষ্টি প্রকাশের সুযোগ নেই। এমনকি তেল আর ঘি সমান মূল্য হলেও।

আমাদের নিকট প্রতিবেশি ভারতের সাথে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অভিন্ন নদীর পানি বন্টন। কারণ, ভারতের মত এই বৃহৎ প্রতিবেশি বাংলাদেশের সাথে অভিন্ন ৫৪টি নদীর উজানে একতরফা বাঁধ নির্মাণ করে স্বাভাবিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। যা ভারতে মত বৃহত রাষ্ট্রের হীনমন্যতা বৈ কিছু নয়। বিষয়টির একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকারের ত্রিশ সালা গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই চুক্তির মহাত্ব নিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা আমাদেরকে আরব্য রজনীর অনেক কেচ্ছা-কাহিনী শোনালেও আমরা কখনো পানির নায্য হিস্যা পাইনি। কাজীর গরু কাগজেই আছে, গোয়ালে তার কোন অস্তিত্ব দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বৃহত রাষ্ট্র ভারতও উদারতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি।

ভারত আমাদের তিস্তা নদীর উজানে সীমান্ত থেকে ১ শ কিলোমিটার দূরে গজল ডোবায় বাধ নির্মাণ করে আমাদের দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। প্রমত্তা এই তিস্তানদী এখন আর আমাদের জন্য গৌরব ও ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে না। কারণ গজলডোবা আমাদের সকল স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে করে দিয়েছে। চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো আর গজল ডোবার কারণে তিস্তাও আমাদের জন্য দুঃখের স্মারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকরা আমাদেরকে এ নিয়ে প্রবোধ দিতে মোটেই কসুর করেন নি বরং বরাবার তিস্তাচুুক্তির চটকদার কাহিনী শুনিয়েছেন। জনগণের নাকের ডগায় মূলা ঝুলিয়ে অনেক কিছু প্রতিবেশীর হতে তুলে দেয়া হলেও রাজনীতিকরা যেমন এখনও আমাদেরকে এখনও প্রবোধ বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তেমনিভাবে বৃহত প্রতিবেশী ভারতও একই বৃত্তে আটকা পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দেশটির ভূমিকা সময় ক্ষেপনের কৌশল বলেই মনে করার মত যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত সফল করলেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে এখনও জানা যায়নি। এমনকি বিষয়টি উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনায় এসেছে এখন খবরও কারো কাছে নেই। অথচ তিস্তা চুক্তিকে ভিত্তি ধরেই আমরা অনেক কিছুই করেছি। গত বছরের এপ্রিলে নরেন্দ্র মোদীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদেই তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ভারতে বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কথায় আমারা আবারও আশাহত হয়েছি। তিনি সম্প্রতি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত সরকার তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। তার ভাষ্য অনুযায়ি ‘তিস্তা চুক্তি শুধু ভারত আর বাংলাদেশ এই দুই সরকারের বিষয় নয়, পশ্চিমবঙ্গও সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ। বাস্তবতা যদি তাই হয় তবে তিস্তা চুক্তির কথা
বলে বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? তিস্তাচুক্তি যদি ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার ভুক্তি না হয় তাহলে বিষয়টি নিয়ে এতদিন ‘কানামাছি’ খেলার হেতুটাই বা কী? বিষয়টি কি কুটনৈতিক চৌর্যবৃত্তি নয়? বিষয়টি আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদেরকে তিস্তাচুক্তির মত ছেলে ভোলানো ছড়া শুনিয়ে অনেক কিছু বাগিয়ে নেয়ার পর এক প্রাদেশিক সরকারের আপত্তির বাহানা তুলেছে। কুটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আগেই অভিযোগ করেছিলেন যে, ভারত সরকার মততা ব্যানার্জীর আপত্তিকে বাহানা হিসেবে ব্যবহার করছে। আসলে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মোটেই আন্তরিক নয়। শোনা যাচ্ছে যে, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তিস্তার পানির বিকল্প হিসেবে মানসাই, ধরলা ও তোরসা নদীর পানি বন্টনের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, উল্লেখিত নদীগুলো যেমন বাংলাদেশের সাথে ভারতে অভিন্ন নদী ঠিক তেমনিভাবে তিস্তাও অভিন্ন নদী। বিকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে যদি আমরা উল্লেখিত নদীগুলো পানির হিস্যা পাই তাহলে তিস্তার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার কোন যুক্তি থাকে না। কারণ, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা আন্তর্জাতিক আইনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন। ইউরোপের হাসিয়ুর নদী ১৩ রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং তারা সবাই সমতার ভিত্তিতে পানি ব্যবহার করছে। চীনের হোয়াংহো কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাউস, কম্পোচিয়া ৫টি দেশ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে। নীলনদ, আমাজান, সিন্ধু নদীসহ বিশ্বের শত শত নদীর পানি প্রতিবেশী দেশ ব্যবহার করে আসছে। ব্যক্তিক্রম শুধু ছোট মনের বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত।

আমরা মমতা ব্যানার্জীকে একজন বিবেকবান ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই মনে করি। কিন্তু তিস্তাচুক্তি নিয়ে তার একগুয়েমী তার ব্যক্তিত্ব ও প্রজ্ঞার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় না। কারণ, এ বিষয়ে তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি নাকি পশ্চিম বাংলাকে বাংলাদেশ বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি বাংলাদেশের বিষয়ে বেশি খড়গ হস্ত। অবশ্য, যারা এসব অভিযোগ করেন তারা মানসিক বিকারগ্রস্থ বলেই মনে হয়। কারণ, কোন বৃহত রাষ্ট্রের অংশ বিশেষ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হওয়া মোটেই বাস্তব সম্মত নয়। এটাও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল মাত্র। যাহোক তিস্তানদীর পানির হিস্যা আমাদের নায্য পাওয়া। এটা কারো দয়া, দাক্ষিণ্য বা অনুকষ্পার বিষয় নয়। তাই তিস্তাচুক্তির বিষয়ে মমতা দির একেবারে মততাহীন অবস্থান মোটেই যৌক্তিক ও কাক্সিক্ষত নয়।

আসলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছেলে ভোলানো ছড়ার মহড়া চলছে। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা যেমন বাস্তবতা বিবর্জিত হয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতার লড়াইয়ের জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের নিকট প্রতিবেশীও একই আদর্শ অনুসরণ করে আমাদেরকে আমাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মহভঙ্গ হতে শুরু করেছে। তারা আর এসব চটকদার কথায় বিভ্রান্ত হতে রাজী নয়। তাই আমাদের দেশের রাজনীতিক ও নিকট প্রতিবেশীদের আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। কারণ, মানুষ আর ছেলে ভোলানো ছড়ায় বিভ্রান্ত হতে রাজী নয়। smmjoy@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/333441