৭ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

ঈদ যাত্রায় আগে নেমেও ভোগান্তি

গত ৪ জুন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঈগল পরিবহনের বাসের টিকিট কিনেছিলেন সোনিয়া খাতুন, তাঁর বোন ইলমা খাতুন ও ননদ তামান্না ইসলাম। বাসা রাজধানীর নর্দায়। গতকাল বুধবার সকালে বাসা থেকে বের হয়ে তিনজনই বসুন্ধরা গেটের কাছে ঈগল কাউন্টারে এসে দেখেন, তাঁদের বাস নির্ধারিত সময় সোয়া ৮টার আধাঘণ্টা আগেই ছেড়ে গেছে। বসুন্ধরা কাউন্টার থেকে তিন যাত্রীকে আবদুল্লাহপুর কাউন্টারে যেতে বলা হয়। গিয়ে দেখা যায়, টিকিট প্রদানকারী অনলাইন প্রতিষ্ঠান সেমিকন লিমিটেড টিকিটে বাস ছাড়ার ভুল সময় উল্লেখ করেছিল। আবদুল্লাহপুরের কাউন্টারে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর নতুন টিকিটে তিনজন খুলনার পথে রওনা দেন। ঈদের এক সপ্তাহেরও বেশি আগে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি গেলেও শুরুতেই তাদের হোঁচট খেতে হয়েছে। গতকাল রাতে সোনিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছয় ঘণ্টার পথ, আমাদের লাগল ১০ ঘণ্টা। আবদুল্লাহপুর, সাভার, পাটুরিয়া হয়ে খুলনার দৌলতপুরে এসেছি। বিভিন্ন স্থানে যাত্রী তোলা ও বিভিন্ন কারণে বাস থামিয়ে রাখা হয়েছে।’
এদিকে বাসের কাঙ্ক্ষিত আগাম টিকিট ৩০ মে ও ১ জুনই শেষ হয়ে গেছে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিটের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজেও টিকিট মিলছে না। গতকাল দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে আগাম টিকিট বিক্রির শেষ দিনে ভিড় ঠেলে, চোখের জল মুছতে মুছতেই নাজমুল হক সৈকত বললেন, ২২ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও চট্টগ্রাম যাওয়ার টিকিট পেলাম না।

আগামী ১৬ জুন ঈদুল ফিতর হতে পারে ধরে নিয়ে বাস ও ট্রেনের ১০ থেকে ১৫ জুনের আগাম টিকিট বিক্রি হয়েছে। গতকাল ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হয়েছে। তারও আগে শেষ হয়েছে বেসরকারি বাসের কাঙ্ক্ষিত টিকিট। আজ বৃহস্পতিবার থেকে লঞ্চের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হবে। বিআরটিসি বাসের টিকিট বিক্রির দ্বিতীয় দিনে অবশ্য যাত্রীদের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মেলেনি।
জানা গেছে, ট্রেনের টিকিটের ৩৫ শতাংশই যাচ্ছে কোটায়। ভিআইপিদের জন্য ৫ শতাংশ থাকলেও রাখা হচ্ছে তার বহুগুণ টিকিট। অনলাইনে বিক্রির জন্য ট্রেনের ২৫ শতাংশ টিকিট থাকলেও গত চার দিনে অনলাইনে ঢুকতেই পারছে না ক্রেতারা। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-দিনাজপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা রুটে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে ভিআইপিদের। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন জানান, এবার শেষ দুই দিনে সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল। সবাই যেন ট্রেনে যেতে চায়। কিন্তু সবাইকে তো আর পরিবহনের সক্ষমতা নেই রেলের।
রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, বিভিন্ন বাস কাউন্টার, কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন, সদরঘাট থেকে আগাম ঈদ যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে পথে নেমেই যাত্রীরা অসহায় হয়ে পড়ছে। ঢাকার বাসা থেকে বের হয়ে মহাসড়কে ওঠার যাত্রাটি নির্বিঘ্ন করতে কোনো উদ্যোগও নেই স্থানীয় সরকার বিভাগের। ঢাকার প্রধান প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর, মহাখালী-আবদুল্লাহপুরসহ চারটি প্রধান পথই যানজটে অবরুদ্ধ থাকছে। গতকাল দুপুরে বৃষ্টি হলে এসব পথ যানজট ও জলজটে অচল হয়ে পড়ে। মোহাম্মদপুর থেকে মহাখালী বাস টার্মিনালে যাওয়ার পথে জাহাঙ্গীর গেটের সামনে টানা ২০ মিনিট যানজটে থাকা অটোরিকশার যাত্রী শফিকুর রহমান বলেন, ‘ঈদের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। যেহেতু টাঙ্গাইলের মধুপুর যাব, আগাম টিকিট নিতে হবে না মহাখালী থেকে। তবে রাস্তায় চলতে চলতেই কোমর ভেঙে যাচ্ছে।’

ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই যানজট, বাস ও ট্রেনে সময়সূচি বিপর্যয়সহ বিভিন্ন বিঘ্ন ঘোচাতে এবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, মহাসড়ক পুলিশ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগ নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সড়কমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন মহাসড়কে ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে অংশীজনদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে সভা করেছেন। সমন্বয়ের সব ধরনের চেষ্টায় তাঁর কমতি নেই। তিনিই ছুটে চলেছেন এক মহাসড়ক থেকে অন্য মহাসড়কে। ঈদ যাত্রা সামনে রেখে মহাসড়কে যানজট ঠেকাতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ, অনুপযোগী গাড়ি চালানো বন্ধ রাখা ও উল্টোপথে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখতে গত ৩ জুন বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে অন্যান্য কোনো সংস্থা থেকে এমন উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। গত কয়েক দিন সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর গাবতলী, মাজার রোড, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, কাজলা, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার চৌরাস্তা, কাঁচপুর সেতু, পোস্তাগোলা, বাবুবাজার, তাঁতি বাজার, সদরঘাট, গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স অংশে নিয়মিত যানজট হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মাঠে থাকার নির্দেশনা নিয়েই যেন দায় সেরেছে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম। এটিও একটি সুন্দর মহাসড়ক। তবে সাভারের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর, সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর, নয়ারহাট, কালমাপুরে এখনই যানজট হচ্ছে। গোলড়া বাসস্ট্যান্ড, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, বানিয়াজুড়ি বাসস্ট্যান্ড, উথুলি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যানবাহন যাতে এলোপাতাড়িভাবে না রাখা হয় তার জন্য প্রশাসনের উদ্যোগ নেই বলে পরিবহনকর্মীরা জানিয়েছেন। বরিশাল-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কের শেখ জামাল সেতু থেকে কলাপাড়ার পাখিমারা বাজার পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক নাজুক। এ ধরনের মহাসড়ক আগামীকাল ৮ জুনের মধ্যে সংস্কার শেষ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব স্থানেই ভাঙা সড়ক মেরামত শেষ হয়েছে। এবার কেন্দ্রীয়ভাবে আন্ত মন্ত্রণালয় সভা হয়নি। তবে ফেনী, ভুলতাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়কমন্ত্রী মহাসড়ক পুলিশ, উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অংশীজনদের নিয়ে সভা করেছেন।
যাত্রীর চাপ সামাল দিতে ২০১২ সাল থেকে পোশাক শ্রমিকদের ভিন্ন দিনে ছুটি দেওয়ার রীতি চালু করা হয়েছে। এ রীতি চালুর পরও যাত্রীর চাপ কমেনি। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে যাত্রীরাই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাড়ি যাত্রা শুরু করে। ফলে ২০১৫ সাল থেকে ঈদযাত্রা আগের বছরগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত নির্বিঘ্ন হচ্ছে। তবে এবার দফায় দফায় বৃষ্টিপাতে সওজ অধিদপ্তরের অনুপযোগী সড়ক মেরামত করা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রেলপথে নেই পর্যাপ্ত বগি, নৌপথে নেই পর্যাপ্ত নৌযান।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এবার ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটি ১৫ লাখ যাত্রী ঢাকা ছাড়তে পারে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানী এখন মানুষের চাপেই মৃতপ্রায়। এটি স্থানান্তর করতে হবে অন্যত্র। কারণ এটি এখন হাসপাতালের আইসিইউতে আছে। কোনো উৎসবে বাড়ি যাত্রায় কী পরিমাণ যাত্রী ঢাকা ছাড়বে তার হিসাব কারো কাছে নেই। যেখানে এ পরিসংখ্যানই নেই তাহলে পরিকল্পনাও সঠিক হবে না। কত যাত্রী ঢাকা ছাড়বে তার পরিসংখ্যান সামনে রেখে যোগাযোগের সব মাধ্যমের সক্ষমতা যাছাই করে তারপর বহু মাধ্যমভিত্তিক যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করলে তা সুষম হতো, শৃঙ্খলা থাকত।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, স্বাভাবিক সময়েই ট্রেন ঢাকা থেকে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ কম যাত্রী পরিবহন করে। এ অবস্থায় ঈদে চাপ বাড়ে কমপক্ষে ছয় গুণ। জানা যায়, ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ৩১টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ৯টি বিশেষ ট্রেন। থাকবে কিছু মেইল ও কমিউটার ট্রেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতিদিন গড়ে ছেড়ে যায় প্রায় ১০ হাজার বাস ও মিনিবাস। ঈদের মৌসুমে তার সঙ্গে যোগ হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়ি। ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে চলাচল করে অনুপযোগী ও মহাসড়কে দূরপাল্লায় চলাচলের অনুমতিহীন প্রায় পাঁচ হাজার বাস ও মিনিবাস। এরই মধ্যে দূরপাল্লায় চলাচলের জন্য চুক্তি করা শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার মিরপুর থেকে নতুন বাজার পথে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের কর্মী শরীফ মিয়া জানান, তিন দিনের জন্য একটি বাস চুক্তি করা হলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটেই ৩০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।

ফিটনেসহীন গাড়ি মহাসড়কে বিকল হয়ে যানজট সৃষ্টি করতে পারে। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাই রাজধানীর মিরপুর মাজার রোড, টেকনিক্যাল, যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন পরিবহন কারখানা নিজে পরিদর্শন করে বিস্মিত হয়েছেন। তারপর বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে গত ৩ জুন পরিবহন মালিকদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন। বিআরটিএর উদ্যোগে এসব কারখানায় অভিযান চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রাক পিকআপে যাত্রী বহন করার প্রস্তুতি চলছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/06/07/645148