৭ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৮

ব্যয় বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাস্তবায়ন ঢিমেতালে

৩ বছরের প্রকল্প এখন ১১ বছরে ;৩১ কোটি টাকা থেকে ব্যয় ৩৯০ কোটি টাকায়

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চলে ঢিমেতালে। বছরের পর বছর চলে; প্রকল্প শেষ হয় না। কিন্তু এর বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প প্রণয়ন, ধারণার ওপর প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দফায় দফায় নতুন নতুন অঙ্গসংযোজন, বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতায় বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। যে প্রকল্প পৌনে তিন বছরে শেষ করার কথা তা চলছে ৯ বছর ধরে। ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প এখন ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নীত হচ্ছে। ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা যে প্রকল্প তা শেষ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচনে বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমিকে (বাপার্ড) আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান করতে এই ৩০ কোটি ৩১ লাখ ২৩ হাজার টাকায় ২০১০ সালের মার্চে একটি প্রকল্প নেয়া হয়, যা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা। উদ্দেশ্য বিআরডিবির আওতাধীন কোটালীপাড়ার প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্সটির উন্নয়ন। বাপার্ড নামকরণ করা হয় ২০১২ সালে। স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে ২০১৩ সালে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে হয় ২২৭ কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের জুনে বর্ধিত এ মেয়াদ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে রেইট শিডিউল পরিবর্তনের কথা উঠে। তখন নির্মাণ ব্যয় ও মেয়াদ ফের বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। বছর পার হতেই এ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব। আরো দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর সাথে সাথে ব্যয় বৃদ্ধি দাঁড়াচ্ছে ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৭১ হাজার টাকায়। এটিও চলতি ২০১৮ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। এখন ব্যয় আবার বাড়িয়ে ৩৮৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিন বার একটি প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে।

প্রকল্পের ব্যয় ও কাজের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে ২০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব নিয়ে প্রকল্পটি ২০১০ সালে অনুমোদন দেয়া হয়। জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ দ্বিতীয় দফায় ৪০ একর করা হয়। তৃতীয় সংশোধনে এটি ৫০ একরে উন্নীত করা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে ডিজির বাংলো নির্মাণ, জামে মসজিদ ও ওয়াল নির্মাণ, কম্পিউটার ৩০ থেকে ১০০টি, মিনি পার্ক নির্মাণ, পুকুর খনন, লন টেনিস ও ব্যাটমিন্টন কোর্ট নির্মাণ নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি দুই বছর ৯ মাসে শেষ করার কথা ছিল। সেটি এখন ১০ বছর মেয়াদে চলে যাচ্ছে।

৬৪ জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বিল্ডিং নির্মাণ প্রকল্পটি ৭৩১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৪ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন ২০১৮ সালের জুন চলছে। প্রকল্পটি অতিরিক্ত চার বছর ধরে চলছে। এরই মাঝে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে দু’বার। এখন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে দুই হাজার ৩৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। মূল ব্যয় থেকে এ ব্যয় বেড়েছে এক হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বা ২২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৮৭০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এ সময় মেয়াদ বাড়ে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। পরে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং মেয়াদ ২০১৮ সালের সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি এখনো শেষ হয়নি। অথচ জুন চলমান। এখন আবার নতুন করে তিন বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে যৌথভাবে আইন ও বিচার বিভাগ এবং গণপূর্ত অধিদফতর।

আইএমইডি বলছে, ৬৪ জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪২টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ এবং ২২টি জেলায় ভবন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের সংস্থান রয়েছে। তবে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে গত মার্চ পর্যন্ত মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বা এক হাজার ২৯৬ কোটি ৪২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূল্যায়নকারী সংস্থাটি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ১৩টি ভবন পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে তারা দেখেছে, মানিকগঞ্জ জেলার ভবনে মোজাইক ফিনিশিং ভালো হয়নি, রাজশাহী জেলায় সিঁড়ি মানসম্পন্ন হয়নি। খুলনায় ভবনের দেয়ালে শেওলা ধরেছে। কাজের মান ভালো না হওয়ায় তৃতীয় তলার বাথরুম বেশি ব্যবহৃত হলে দোতলায় বাথরুমে ছাদ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ে বলে খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির ব্যাপারে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু দুর্বল দিক চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হলো, প্রকল্প প্রণয়নে ধারণাগত জ্ঞানের অভাব, প্রকল্পের ডিজাইন করার েেত্র অদূরদর্শিতা, প্রকল্প প্রণয়নে কোন কাজে কত সময় লাগতে পারে ওই বিষয়ে ধারণা কম থাকা, ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়নে অনির্দিষ্টতা, সময়মতো ডিজাইন সরবরাহ করতে না পারা, ২৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পগুলো সমীক্ষা করার বিধান থাকলেও সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, সুবিধাভোগীদের দিক বিশ্লেষণ না করা ও ভৌত অগ্রগতি পরিমাপ করতে না পারাই প্রকল্পে ব্যয় বাড়ে। স্থবিরতা চলে আসে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/323510