৭ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭

প্রতি ঈদে বাংলাদেশ হারায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা

* কেনাকাটার জন্য কয়েক লাখ লোক ভারতে
* ভারতীয় কাপড়ে ঢাকার বাজার সয়লাব

ঈদ উপলক্ষে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে গেছে প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশী। প্রতি ঈদে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাচ্ছে ঢাকার দোকান মালিকরা। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস ও ভারতীয় অনলাইন ওয়ান ইন্ডিয়া এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, প্রতি বছরই ঈদ উপলক্ষে কয়েক লাখ বাংলাদেশী নিত্যনতুন পোশাক কিনতে ছুটছে ভারতে। ঢাকায় পোশাকের দাম অত্যধিক। ঈদের সময় দাম আরো বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। ভালো বিক্রির কারণে বিক্রেতাদের আচরণও তখন পাল্টে যায়। অন্য দিকে ভারতের বাজারে পোশাক পাওয়া যায় লেটেস্ট মডেলের। দামও অপেক্ষাকৃত কম। ঈদ উপলক্ষে তারা বিশেষ ছাড়-অফারও দেয়। ভিসা পাওয়ার জটিলতাও এখন আর আগের মতো নেই। বিমানের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথে যাতায়াত এখন অনেক সহজ। এসব কারণে ঈদ উপলক্ষে দেশের ক্রেতারা দলে দলে কলকাতায়, দিল্লী, বোম্বাই, শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছেন। কেবল ঈদের কেনাকাটার জন্য ভারতে গেছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশী। এ দেশের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন হাজার কোটি টাকার ঈদবাজার। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অধিক ভ্যাট এবং দোকান ভাড়ার কারণে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।

ভারতীয় পোশাকে বাংলাদেশের ঈদের বাজার ছয়লাব। এমনকি হরেক নামের ও দামের ভারতীয় পোশাক এ দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। তবুও ভারতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঈদের কেনাকাটা করছেন অনেকেই। ভারতে গিয়ে শপিংয়ের এ মনোভাব কেবল উচ্চবিত্তে নয়, মধ্যবিত্তকেও গ্রাস করেছে। প্রতিদিনই দেশের হাজার হাজার মানুষ ঈদ উপলক্ষে শপিং করতে ছুটছেন কলকাতার বিখ্যাত বিগ বাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটের উদ্দেশ্যে । এবার ঈদের কেনাকাটায় দেড় লাখেরও বেশি বাংলাদেশী ভারতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কলকাতা থেকে ঈদের বাজার করে আসা কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশী ক্রেতা ধরতে ভারতে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বাজার। বিশেষ করে কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মীর্জা গালিব স্ট্রিট, মল্লিকবাজার, বেলগাছিয়া, নিউমার্কেট, চিৎপুর, টালিগঞ্জ, এন্টালি, আনোয়ার শাহ রোড, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, পার্ক স্ট্রিট, চিৎপুরের জাকারিয়া স্ট্রিট, ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ চত্বর এলাকায় ইতোমধ্যে ঈদের জমজমাট বিক্রি শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় অস্থায়ী ভিত্তিতে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ধর্মতলা থেকে গড়িয়াহাট, শিয়ালদহ থেকে রাজাবাজার বা বেলগাছিয়া-পার্ক সার্কাস থেকে এন্টালি-খিদিরপুর এলাকায়ও ঈদের কেনাকাটার ধুম লেগেছে। কলকাতার বিখ্যাত বিগ বাজার, শ্রী লেদারস, খাদিম, সাউথ সিটি মলসহ বিভিন্ন মার্কেটে ঈদ উপলে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর বিশেষ ছাড়ও দেয়া হচ্ছে। ব্র্যান্ডের দোকানগুলো ছাড়াও বড় বাজার বা চায়না মার্কেট এলাকায় পাইকারি মূল্যে শাড়ি, থ্রিপিস, প্রসাধনী কিনছেন অনেক বাংলাদেশী।
প্রতিদিনই দেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ শপিং করার উদ্দেশে যাচ্ছে কলকাতার বিভিন্ন মার্কেটে। আর এ কারণে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে ভারত যাতায়াতকারীদের। সোস্যাল মিডিয়ার প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছে ভারতে। বিশেষ করে কলকাতায়। ভারতে ঈদের শপিং করছে তারা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে এখন ভারতীয় পোশাকে সয়লাব। তা সত্ত্বেও সে দেশের নাগরিকদের ফেভারিট শপিং ডেস্টিনেশন এখনো ভারতই। এবার ঈদের কেনাকাটায় দেড় লাখেরও বেশি বাংলাদেশর ভারতে যাওয়ার কথা রয়েছে।

এতে বলা হয়, ভারতীয় হাই-কমিশন গত বছরে অতিরিক্ত ১ লাখ ভিসা দিয়েছিল। গত বছরের চেয়ে এবার আরো বেশি মানুষ কেনাকাটা করতে আসবে বলে জানা গিয়েছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী তানবির হাসান ভারত থেকে ঈদের কেনাকাটা করেছে। সে জানায়, “কলকাতার নিউমার্কেট এলাকাসহ আশপাশের মার্কেটগুলোতে বাংলাদেশি ক্রেতাদের প্রচ- ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় পঁচিশ হাজার বাংলাদেশী ক্রেতা আসছে শুধু নিউ মার্কেট চত্বরে। সংখ্যাটা দেড় লাখ থেকে দু’লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।” এফবিসিসিআই অফিস সূত্রে জানা যায়, কেনাকাটা করতে অন্য দেশে যাওয়া তখনই বন্ধ হবে, যখন দেশেই মানসম্মত পণ্য পাওয়া যাবে প্রতিযোগিতামূলক দামে। এমন অনেক পণ্য হয়ত আছে যেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেলেও কিছুই করার নেই।

ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াত আরো সুগম করতে ২৪টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াতকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসায় প্রবেশ ও প্রস্থান নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করা হয়েছে। ভিসাপ্রাপ্তি সহজতর করতে ঢাকার বাইরে বড় শহরগুলোয় বেশ কিছু ভিসা সেন্টার খোলা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকহারে ভারতীয় ভিসা গ্রহণ করছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভারতীয় ভিসা গ্রহণকারীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। কেবল রমজানের শুরুতেই ভিসা গ্রহণ করেছেন দেড় লক্ষাধিক বাংলাদেশী। এর বাইরে বিনা ভিসায় ভারত সফরকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কত টাকা ভারতে যাচ্ছে তার সঠিক কোনো হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই। বৈধভাবে পাসপোর্টে এনডোর্স করে ডলার নিয়ে যাওয়ার প্রকৃত পরিমাণও জানা নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কারণ অনেক পর্যটক মানি চেঞ্জার কোম্পানির মাধ্যমে ডলার এনডোর্স করান। এ ছাড়া বেশির ভাগ পর্যটক নগদ টাকা, রুপি কিংবা ডলার নিয়ে ভারতে যান। ভারতীয় রুপি যেমন বাংলাদেশে সচরাচর পাওয়া যায়, তেমনি বাংলাদেশী টাকাও সে দেশে অহরহ বিনিময় হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে বৈধভাবে কেবল ব্যাংকের মাধ্যমে এনডোর্স করা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থের প্রকৃত পরিমাণ এর শতগুণেরও বেশি বলে সংশ্লিষ্টদের অনুমান।

কেনাকাটা করার জন্য ভারতে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সদ্য কলকাতা ফেরৎ বেসরকারি সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, একটা নতুন ডিজাইন প্রথমে কলকাতায় আসে তার পর আসে ঢাকায়। কাজেই সেখান থেকে সর্বাধুনিক ফ্যাশনটি আগে পাওয়া যায়। আমাদের এখানে যেসব পোশাক বিক্রি হয় তার বড় অংশই আসে ভারত থেকে। আমাদের ব্যবসায়ীরা ওখানকার পোশাক এনে বাংলাদেশে বিক্রি করে কিন্তু দাম রাখে দ্বিগুণের বেশি। ঢাকায় যে জামার দাম পাঁচ হাজার টাকা, কলকাতায় সেটি পাওয়া যায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার বাংলাদেশী টাকায়। তিনি বলেন, দাম ও মান ছাড়াও আরেকটা বড় ব্যাপার হলো ব্যবহার। ভারতে যেকোনো দোকানে আপনি ২০০ টাকার শাড়ি কিনলে ১০০টি শাড়ি দেখাবে। কিন্তু বাংলাদেশের দোকানিদের মধ্যে সেটি নেই। এখানে অনেক সময় পোশাক পছন্দ না হলে ক্রেতারা ফিরে গেলে তখন অনেক আজেবাজে কথা বলে বিক্রেতারা। ঈদ উপলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা যেখানে দাম বাড়িয়ে দেন সেখানে বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বড় কথা, ভিসা ও যাতায়াত যখন সহজ তখন বাজার করতে গিয়ে বিদেশ ঘুরে আসার সুযোগ কে ছাড়ে, মন্তব্য তার। ঈদের কেনাকাটার জন্য লোকদের দলে দলে ভারতে যাওয়ায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জানিয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্রে জানা যায়, ভারতের দূতাবাস ভিসা সহজ করে দিচ্ছে। বাস ও ট্রেনের টিকিট দেখালেই ছয় মাসের ভিসা দিচ্ছে। সেখানে দামও কম। ফলে উৎসব অর্থনীতিতে তিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। আমাদের ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন এ মওসুমটির জন্য। অথচ মওসুম আসার পর দেখা যায় ক্রেতাদের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে চলে গেল। এতে দেশের অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদল মোটা অঙ্কের কর দিয়ে আমদানি করে আনলেন আবার বিক্রির সময় মোটা অঙ্কের ভ্যাট দিলেন। অন্যজন শুল্কমুক্ত উপায়ে কিনে আনলেন এবং দেশে এনে অনলাইনে ভ্যাটমুক্ত উপায়ে বিক্রি করে দিলেন। এটি কোনো নিয়ম হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ঈদ শপিংকে কেন্দ্র করে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেলেও কারো কিছু করার নেই। তারা বলেন, কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে দেশে যে নীতিমালা আছে তারা তা মেনেই করছেন। কেনাকাটা করতে অন্য দেশে যাওয়া তখনই বন্ধ হবে, যখন দেশেই মানসম্মত পণ্য প্রতিযোগিতামূলক দামে পাওয়া যাবে। এ জন্য বাজারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমদানি শুল্ক পর্যালোচনা করে যৌক্তিক করতে হবে। দেশের বাজারে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপের বিষয়টি আরো ভাবতে হবে। সর্বোপরি ব্যবসায়ীদেরকে প্রকৃত ব্যবসায়িক মানসিকতায় আনতে হবে। সুযোগ পেলেই গলা কাটার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের বিপণিবিতানগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

গত শনিবার বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় ঈদের শপিং করতে গিয়েছিলেন ঢাকার একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল তুহিন। তিনি প্রায় লক্ষাধিক টাকার শপিং করে দেশে ফিরেছেন মঙ্গলবার। দেশে ফিরে তিনি বলেন, তিনি তার পরিবারকে খুশি করতে ভারতে গিয়েছিলেন ঈদের কেনাকাটা করতে। ‘ইন্ডিয়ার ট্যাগ লাগানো গিফট দেখলে পরিবারের সবাই খুশি হবে’ এমন ধারণা থেকেই তিনি ঈদের শপিংয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে নিজের বোন, বোনের স্বামী, বাবা-মা, বন্ধুদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করেছেন।

http://www.dailysangram.com/post/333326