৭ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৪

দখল করতে দাপট লাগে

শৈশবের অনেক স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। এর মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঘিরে ছিল আমাদের শৈশব। বিদ্যালয়ের লেখাপড়া, কলকাকলি ছিল আমাদের প্রিয় বিষয়। বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল খেলার মাঠ। তবে আমাদের শৈশবের শিক্ষকরা বোধহয় একটু কড়াই ছিলেন। এখন বুঝতে পারছি, দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতার জন্যই তাঁরা শাসনটা একটু বেশি করতেন। তখন তো শিক্ষার বিষয়টা এখনকার মতো এতটা কমার্শিয়াল ছিল না। এ কারণেই হয়তো আমাদের শৈশবে ‘উস্তাদের কদর’ নামক কবিতা পাঠ্য ছিল। শিক্ষকরা যে শুধু শাসনই করতেন তা নয়, সোহাগও করতেন। তাইতো বলা হয়, শাসন করা তারেই সাজে, সোহাগ করে যে গো।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আজও স্বপ্নে দেখি প্রিয় প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। স্মৃতিগুলো নাড়া দেয়। কিন্তু এখনকার শিশুরা যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে থাকে, তার অবস্থা কেমন? এখনতো আবার বিদ্যালয়ের নানা রূপ, নানা বিন্যাস। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কেমন চলছে? ২ জুন পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘দখলদারদের থাবায় ঢাকার ৩১ প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার ২৫৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৩১টিতে দখলদারদের থাবা পড়েছে। এগুলোর ভবন, জমি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন কমিউনিটি সেন্টার, গ্যারেজ, দোকান, ক্লাবঘর, বস্তি, কাঁচাবাজারসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এর আগে ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর ১০ম জাতীয় সংসদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজধানীর প্রাথমিক স্কুলের জমি অথবা ভবন দখলমুক্ত করতে ৫ সদস্যবিশিষ্ট ৩ নম্বর সাব কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন করে ওই বছরই কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সে সময় কমিটি দখলকৃত ৪৮টি বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন উদ্ধারের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। কিন্তু কয়েকটিতে উদ্ধারের তৎপরতা চালালেও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
ভাবতে অবাক লাগে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দখল হয়ে যায় কেমন করে? যেখানে ছাত্র ও শিক্ষক থাকার কথা, লাইব্রেরি থাকার কথা, সেখানে এখন বিরাজ করছে অন্যকিছু। অর্থাৎ যথাস্থানে যথাবিষয় নেই। প্রশ্ন জাগে, আমাদের প্রশাসন ও সরকার যথাবিষয়ে যথাদায়িত্ব পালনে সমর্থ হচ্ছে না কেন? সমস্যা কি অনেক গভীরে?

শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, নানা ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে দখল-বেদখলের সমস্যা। ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ ছোট্টমণিদের বিদ্যালয় দখল করে কেমন করে? আমরা জানি, সাধারণ মানুষ কিছু দখল করে না, সেই সামর্থ্য তাদের নেই। দখল করতে শক্তি লাগে, অর্থ লাগে, রাজনৈতিক দাপটও লাগে। তাই দখলকর্মে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের পারঙ্গমতাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসন এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তাদেরই নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু তেমন সুশাসন তো বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবশ্য এর দায় সরকারের উপরই বর্তায়। সরকার কিন্তু চাতুর্যময় কথাবার্তা বলে দায় এড়িয়ে যেতে চায়। ফলে নানা ক্ষেত্রে সংকটের মাত্রা বেড়ে চলেছে।

দেশে এখন মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। মাদকের নিয়ন্ত্রণ সবারই কাম্য। কিন্তু প্রতিদিন যেভাবে মানুষ নিহত হচ্ছে তাতে বিষয়টি নিয়ে জনমনে এবং পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, এটা বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-। প্রশ্ন জাগে, নির্বাচনের বছরে মাদকের ব্যাপারে যে কঠোর এ্যাকশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা আরো আগে গ্রহণ করা হলো না কেন? মাদকের বিষবৃক্ষ তো দু’এক বছরে তার ডালাপালা বিস্তার করেনি। প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে মাদকের বিষবৃক্ষ দৃঢ়মূল হয়েছে। এখন সে সর্বগ্রাসী হতে চলেছে। আমরা চাই দেশে মাদকবিরোধী অভিযান সফল হোক। কিন্তু দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোর আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসগুলোকে মাদকমুক্ত করার তেমন কোন প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ‘হাত বাড়ালেই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মাদক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ৪ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে মাদকের অভয়াশ্রম নিয়ে নিউজ করলে যারা জাত গেল জাত গেল বলে সাংবাদিকদের দায়ী করেন তারা সালাম-বরকত হলের ৪০১ নম্বর রুমের পাশের ওয়াশরুমটা একটু ঘুরে যান। মদ, গাঁজা, হেরোইনখোররা ওয়াশরুমগুলোতে বমি করে রাখে। আর বমির দুর্গন্ধে সাধারণ ছাত্ররা অসুস্থ হয়ে পড়ে। হল প্রশাসনকে বিষয়টি কয়েকবার জানানোর পরও পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন জেগেছে, মাদকসেবীদের এমন অনাচার আর কতদিন সহ্য করবে সাধারণ ছাত্ররা ?

প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে নয়, দেশের প্রায় সবক’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোর চিত্র প্রায় একইরকম। রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযান কিংবা রেইডের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য বিশেষ বিধিনিষেধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখন নিরাপদে মদক বিক্রি হচ্ছে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী নিরাপদ আশ্রয় মনে করে হলগুলোতে অবস্থান করছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা মাদকের পৃষ্ঠপোষক ও ব্যবসায়ী হওয়ায় মাদক বিরোধী চলমান সাঁড়াশি অভিযানের তেমন কোন প্রভাব পড়েনি ক্যাম্পাসগুলোতে। অনেকটা আগের মতোই চলছে মাদকের বেচাকেনা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের বিষয়টি জানার পরও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মানের কথা ভেবে অনেক সময়ই কর্তৃপক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে চায় না। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের। ফলে নষ্ট হচ্ছে মেধাবী ছাত্রদের ভবিষ্যৎ। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা দেশের ২২টি জেলার ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৭৮ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে। এর মধ্যে ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৮টি কলেজ রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-শিক্ষক-চিকিৎসক-কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা এবং পুলিশ সদস্য। এমন চিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায় আমাদের ভবিষ্যৎ কতটা অন্ধকার। সরকার ও রাজনীতিবিদরা কি সেই অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন?

 

 

http://www.dailysangram.com/post/333392