৫ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৫৩

খেলাপি ঋণের অর্ধেকই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের

দায় চাপছে পুরো ব্যাংক খাতের ওপর

রাষ্ট্রায়ত্ত বাদে পুরো ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের গড়হার যেখানে ৬ শতাংশ, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই ৩০ শতাংশ। পরিমাণের দিক থেকেও মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক রয়েছে এ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দখলে। এতে বাড়ছে সামগ্রিক খেলাপি ঋণের হার। বলা চলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এ খেলাপি ঋণের দায় সামগ্রিকভাবে চাপছে পুরো ব্যাংকিং খাতের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি যথা সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ১ লাখ ৪১৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। অথচ খেলাপি ঋণের হিসেবে মোট খেলাপি ঋণের ৪৯ দশমিক ৩১ শতাংশই এ ৬ ব্যাংকের দখলে। যেমন, মার্চ শেষে অবলোপন বাদে মোট খেলাপি ঋণ ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এ ৬ ব্যাংকেরই ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ৪১ ব্যাংকের মোট খেলাপির ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের দায় চাপছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সামগ্রিকভাবে জোর দিচ্ছে মোট ঋণের ৮৩ ভাগের ওপর। সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণতো ১৭ ভাগ। সরকারি ব্যাংকগুলোর নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন- সরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক ঋণ খোদ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। এর বাইরে দীর্ঘ দিনের খেলাপি ঋণের সাথে প্রতি বছরই সুদ যোগ হওয়ায় ওই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণও স্ফীত হচ্ছে। এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর সুশাসনের অভাব রয়েছে। এর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপতো রয়েছেই। সবমিলেই সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক অবলম্বন করে। যেটা সরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে ঋণ আদায়ের হার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো অনেক কম। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর উচ্চ খেলাপির দায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিতে পারে না। কারণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার যেখানে ৬ শতাংশের নিচে, সেখানে সরকারি ব্যাংকগুলোর এ হার ৩০ শতাংশের ওপরে। ফলে সামগ্রিক হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে চলছে। অনেক কষ্টা করে খেলাপি ঋণের হার কমিয়েও বছর শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর সাথে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও বদনামের ভাগিদার হচ্ছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ থেকে রেহাই পেত।

তবে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস্ উল ইসলাম গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর নতুন বিতরণকৃত ঋণের খেলাপির হার অনেক কম। তিনি জানান, সরকারি ব্যাংকগুলো দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে ব্যাংকিং করছে। সেখানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে ব্যাংকিং করছে। এ ছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোর নানা কারণে দীর্ঘ দিন ধরে যেসব ঋণ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওই সমস্যা নেই। সবমিলেই বেসরকারি ব্যাংকগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যেও সরকারি ব্যাংকগুলো নানাভাবে চেষ্টা করছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার কমানোর জন্য। ইতোমধ্যে সরকারি ব্যাংক বিশেষ করে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে পেরেছে। পরিচালনা পর্ষদ ভালো হওয়ায় ঋণ আদায়ের হারও অন্য ব্যাংকের চেয়ে ভালো। গত তিন মাসে তারা ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঋণ আদায় করতে পেরেছেন। তবে দীর্ঘ দিনের যেসব ঋণ খেলাপি হয়ে আছে ওই সব ঋণ আদায় না হওয়ায় গড়ে প্রতি বছরই ১০ শতাংশ সুদ যোগ হওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে কোনো কোনো ব্যাংকের। এটা কমানোর জন্য সরকারি ব্যাংকগুলো এখন নানাভাবে চেষ্টা করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সরকারি ব্যাংকের যেভাবে লুটপাট হয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো তার ধারেরকাছেই নেই। যেমন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু স্বয়ং ঋণ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত। বাচ্চুর আমলেই সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম হওয়ায় ব্যাংকটি পথে বসে গেছে। তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। জনতা ব্যাংকের এনন টেক্স, ক্রিসেন্ট লেদার, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির দায় তাদের পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারেন না। অথচ বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকের কারণে খেলাপি ঋণ হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হিসাবের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে না দেখিয়ে আলাদা আলাদা করে দেখানো উচিত।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।

২০১৮ সালের মার্চ শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ শতাংশ। তিন মাস আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
মার্চ শেষে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩১ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০১ শতাংশ। তিন মাস আগে বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/323026