৫ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩৩

শুধু একরাম হত্যা নয় বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই

মে মাসের প্রথম দিকে সূচিত সরকারের তথাকথিত মাদক বিরোধী অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গতকাল রোববার পর্যন্ত ১৪৬ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। সরকারি ভাষায় এদের সকলেই ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন এবং সকলেই অপরাধী এবং মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। মাদক একটি ব্যধি এবং মাদকাসক্তি আমাদের সামাজিক অপরাধের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগের জন্য দায়ী। আমাদের আশপাশের দেশগুলো থেকে অবৈধভাবে চোরাপথে মাদক আমদানী হচ্ছে এবং অসাধু মাদক ব্যবসায়ীরা দেশের যুব সমাজের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে যুব সমাজ সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে অব্যাহতভাবে জড়িয়ে পড়ছে। এতে জনমানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার মাদক বিরোধী অভিযান শুরু করেছেন এবং এ যাবত এই অভিযানে এ যাবত ১৪৬ ব্যক্তি নিহত হবার খবর পাওয়া গেছে।

মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনার পক্ষে সরকারের যুক্তি নি:সন্দেহে প্রশংসাযোগ্য, তারা দেশকে মাদকমুক্ত করে জাতিকে রক্ষা করতে চান। কিন্তু যেভাবে এই অভিযানের নামে সরকারি বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশবাসী বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছেন যে সরকার মাদক বিরোধী অভিযানের নামে মানবতা বিরোধী কর্মকা- পরিচালনা করছেন। এতে বিরোধী দলের ছাত্র ও যুব নেতা এবং সরকারি দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহী ব্যক্তিদের টার্গেট করে বিনা বিচারে তাদের দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। এটা ন্যায় বিচারের প্রতি যেমনি অবজ্ঞা তেমনি সংবিধানেরও লংঘন। দেশে হাজার হাজার আদালত রয়েছে, আদালতের বিচারক রয়েছেন, বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। আইন অনুযায়ী কেউ যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তাকে বা তাদের গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আদালতের হাতে সোপর্দ করবেন। তারা তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যাবতীয় সুযোগ পাবেন এবং বিচারের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তারা যদি অপরাধী সাব্যস্ত হন তা হলে শাস্তি পাবেন। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন জেল, অর্থদণ্ড এবং আইনে যদি মৃত্যুদণ্ড থাকে তাহলে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আদালতের হাতে সোপর্দ না করে গুলী করে তাদের মেরে ফেলা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রীয় ঘাতকের কাজ করতে পারে না। আমাদের সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকসহ বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ব্যক্তি আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সম্পর্কে পরিস্কার ভাষায় বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও কেবল আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইন অনুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।”
একইভাবে এই সিংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে, “আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।”

সংবিধানের এই ধারাগুলোর সুরক্ষা এবং তাদের যথাযথ বাস্তবায়ন সরকারের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের অবহেলা মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে এই অভিযান ও বন্দুকযুদ্ধের অন্যতম ভিক্টিম টেকনাফ আওয়ামী যুব লীগের সভাপতি নিহত একরামকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার নিহত হবার ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত অডিও ক্লিপে দেখা গেছে যে, তাকে হত্যার জন্য যে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজানো হয়েছিল তা আদৌ সত্য নয়, এই অডিও ক্লিপটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে জমা আছে এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্তে একরাম নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে যারা দোষী সাব্যস্ত করেছে তারাই দোষী সাব্যস্ত হবে। তাদের বিরুদ্ধে একশান নেয়া হবে।” একরাম আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতে নিহত হয়েছেন। তারাই তাদের দোষী সাব্যস্ত করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়ার পুলিশ কে? দোষী না নির্দোশ তা নির্ণয় করে শাস্তি দেয়ার মালিক তো আদালত। আদালতের কাজ পুলিশ কেমন করে করতে পারে। কিন্তু কার্যত: দেখা যাচ্ছে সরকার এই দায়িত্বটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য শুভ হতে পারে না। বিচারের দায়িত্ব পুলিশের ওপর ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি প্রতিপক্ষ দমন ও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার একটি অপকৌশল মাত্র। কোনও সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এই ব্যবস্থা চলতে দেয়া যায় না।

ইতোপূর্বে আমি একবার এই স্তম্ভে বলেছিলাম যে রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম, নাই বললেই চলে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন পর্যবেক্ষক ও ছাত্র হিসেবে আমি অর্ধ শতাব্দি ইতোমধ্যে পার করে এসেছি। এই দীর্ঘ সময়ে গত ৯ বছরের ন্যায় ক্ষমতা লিপ্সা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সরকার ও সরকারী দলের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত মিথ্যাচার ও অশালীন কথা বার্তার সীমাহীন মহড়া আর কখনো দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। ক্ষমতার মৌহ ঐশ্যর্য্যরে লোভ মানুষকে বিবেকহীন নির্যাতনকারীর নিকৃষ্টতম পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এ কথাটি আজ থেকে বিশ বছর আগেও আমরা কখনো চিন্তা করিনি। যা ভাবিনি, যা চাইনি তাই এখন হচ্ছে।

আমি মাদক বিরোধী অভিযানে তথাকথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত যুবলীগ নেতা কাউন্সিলার একরামের কথা বলছিলাম। তার মৃত্যু সংক্রান্ত ভিডিও ক্লিপ প্রকাশিত হবার পরে এবং সরকারের হাতে ন্যস্ত করায় সরকার ও তার মন্ত্রীরা বিষয়টি তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেতু মন্ত্রী বলেছেন এ ধরনের অভিযানে দু’একটি ভুল হতেই পারে। একজন মন্ত্রীর জন্য এ ধরনের মন্তব্য শোভা পায় না। তথাপিও বলছি, শুধু একরাম নয় এই পর্যন্ত যতগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে তার প্রত্যেকটির আলাদাভাবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া অপরিহার্য। সাথে সাথে এই ‘বন্দুক যুদ্ধ’ ‘এনকাউন্টার’ ও ‘ক্রস ফায়ারে’ মানুষ হত্যা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশের কোনো মানুষই তার জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ মনে করতে পারছেন না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারী সন্ত্রাসও সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা আসছে সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের কাছ থেকে। সরকার প্রধান ভাবল ঝঝঋ এর নিরাপত্তা পাচ্ছেন। এমপি মন্ত্রী ও দলীয় নেতৃবৃন্দ পুলিশী প্রটেকশান পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ কি পাচ্ছেন? তাদের ধরে নিয়ে গুম হত্যা করা হচ্ছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। অনেকে আন্দোলনের কথা বলেন। সরকারের দুঃশাসন অবসানের আন্দোলন। দেশে বিদেশে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আসলে কি আন্দোলন হবে? হলে কোন দিন থেকে? কি ধরনের আন্দোলন? আবার অনেকে বিএনপির নেতৃত্বের আন্দোলন করার সামর্থ্য আছে কিনা তাও জানতে চান। কেউ কেউ জোট শরিক জামায়াতকে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। যারা সরকারী দলের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা তাদের অনুকম্পা প্রাপ্ত থিংক ট্যাঙ্ক তারা আন্দোলনের ইস্যু নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়ান যে বাংলাদেশে এখন আন্দোলনের কোন ইস্যু নেই, দেশটি উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে; বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। নদীর উষার পুল তৈরি করতে পারি বা না পারি অন্ততঃ ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে ডাঙ্গায় রাস্তার উপর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তো অসংখ্য ওভার ব্রিজ আমরা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি। এসব প্রশ্নের উত্তর সহজে দিতে পারি না। যেমন পারিনা যদি কেউ প্রশ্ন করে বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি কোথায় ভোট দিয়েছি। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের জবাব আমাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার কেউই দিতে পারবেন না। আমার মত তাদের এলাকাতেও ভোট হয়নি। বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন। বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসায় এবং ক্ষমতা প্রলম্বিত হওয়ায় তারা জনগণের কাছে জবাবদিহি ছাড়াই দোর্দ- প্রতাপে দেশ শাষন করছেন। জবাবদিহিতা না থাকায় তারা জনগণকে ভয় পান না। অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে প্রথম প্রথম তারা কিছু ভয়ভীতির মধ্যে ছিলেন এবং আশংকা ছিল যে দুবছরের মধ্যে হয়ত নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু কোনও প্রকার গণআন্দোলন না হওয়ায় তারা দুঃসাহসী হয়ে উঠে। এখন পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা তারা তাদের বৈধ অধিকার বলে মনে করছেন। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার যদি জনগণের কোনও প্রকার প্রতিরোধের সম্মুখীন না হন তা হলে দশম সংসদের ন্যায় একটি প্রতারণার নির্বাচন আগামীতেও হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়। এবং তা যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যমান দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার আরো অবনতি হতে পারে বলে অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। এ অবস্থার যাতে সৃষ্টি হতে না পারে তার জন্য দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/333170