ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা ফ্লাইওভারের নিচে এই যানজট নিত্যদিনের। কোনো কোনো সময় সেটা বিস্তৃত হয় কাঁচপুর পর্যন্ত। তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে-
৪ জুন ২০১৮, সোমবার, ১১:৪৫

ভয় মহাসড়কেই

ঈদযাত্রা

ঢাকা থেকে সড়কপথে রংপুর যেতে এখন সময় লাগে অন্তত ১০ ঘণ্টা। অথচ এক যুগ আগেও ৩৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক পাড়ি দেওয়া যেত মাত্র ৫ ঘণ্টায়। কিন্তু এবার ঈদযাত্রায় এই সড়ক পাড়ি দিতে আরও বেশি সময় লাগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢাকা-রংপুর রুটে চলাচলকারী বাস সার্ভিস আগমনী এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী সমকালকে জানান, চন্দ্রা-জয়দেবপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এ জন্য ঢাকা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত বাস চলে ধীরগতিতে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর সিরাজগঞ্জের সড়কও ভাঙাচোরা থাকায় বেশি গতিতে বাস চলতে পারে না। এসব বিপত্তির কারণে যানজট না থাকলেও ঢাকা-রংপুর যেতে প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। ঈদ মৌসুমে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকে বেশি। স্বাভাবিকভাবে তাই সময়ও লাগবে বেশি।

শুধু ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটে নয়; একই পরিস্থিতি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় পৌনে চার হাজার কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ৮শ' কিলোমিটারই ভাঙাচোরা। ২৩৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। আঞ্চলিক মহাসড়কের ৯২০ কিলোমিটারও কমবেশি ভাঙাচোরা এবং ২৯৪ কিলোমিটার চলাচলের অযোগ্য। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার জেলা সড়কও খানাখন্দে ভরা।

সরকারি পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাতটি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চারটি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহের তিনটি স্থান যানজটপ্রবণ। ভাঙা রাস্তা, চলমান নির্মাণ কাজ এবং অব্যবস্থাপনাকে যানজটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে গত মাসে বিস্তারিত পরিকল্পনা হাতে নেয় সড়ক পরিবহন বিভাগ। ঈদের আগেই মহাসড়কে চলমান নির্মাণ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। কিন্তু পরিকল্পনার অধিকাংশই এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ায় যানজট থেকে রেহাই মেলেনি।
সম্প্রতি দেশের ছয়টি জাতীয় মহাসড়ক সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে সমকাল প্রতিনিধিরা দেখতে পান, এখনও বিভিন্ন স্থান ভাঙাচোরা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে ভাঙাচোরা সড়কে ইট-সুরকি ফেলে সাময়িকভাবে 'মেরামত' করেই দায়িত্ব শেষ করেছে সওজ। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ইট-সুরকির সেই প্রলেপও ধুয়ে গেছে অনেক স্থানে। তাই এবারও ঈদযাত্রায় মহাসড়কে যানজট ও ধীর গতিতে দুর্ভোগের আশঙ্কা কাটছে না।
অবশ্য সড়কের কারণে এবার ঈদযাত্রায় যানজট হবে না বলে আশা করছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়কের কারণে যানজট-দুর্ভোগ হয় না বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, ফিটনেসহীন যানবাহনের কারণেই ঈদযাত্রায় যানজট সৃষ্টি হয়। এ জন্য ফিটনেসহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৮ জুনের মধ্যে সব ভাঙাচোরা সড়ক সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হকের মতে, ঈদের আগে মহাসড়ক মেরামতের এই প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। প্রতি বছর ঈদের আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক মেরামতের ধুম পড়ে। কিন্তু এসব সাময়িক সংস্কার টেকসই হয় না। এ খাতের পুরো ব্যয়ই মূলত জলে যায়।

ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হচ্ছে ১৪ জুন থেকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) ঈদ হওয়ায় এবার ছুটি মিলবে সাকল্যে তিনদিন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, লম্বা ছুটি থাকলে মানুষ ধাপে ধাপে শহর ছেড়ে গ্রামে যেত। মাত্র তিন দিনের ছুটি; তাই সবাই একসঙ্গে পথে নামবে। শহরে ফিরবেও একসঙ্গে। এতে সড়কের ওপর তীব্র চাপ তৈরি হবে। পাঁচ কোটি মানুষ ঈদে শহর ছেড়ে গ্রামে যায়। এত মানুষের যাতায়াতের জন্য সড়ক প্রস্তুত না থাকায় দুর্ভোগের আশঙ্কা রয়েছে।

যানজট কমলেও ভয় চট্টগ্রামের পথে :ফেনীতে রেলওয়ের ওভারপাস নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট আপাতত কমেছে। কিন্তু ঈদযাত্রায় চাপ বাড়লে আবারও দুর্ভোগ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সওজের জরিপ অনুযায়ী, এই মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর দুটি অংশের ২০ মিটারের অবস্থা দুর্বল। চট্টগ্রামের প্রবেশমুখে (২৬৯.৭৬ কিলোমিটার থেকে) প্রায় এক কিলোমিটারের অবস্থাও খারাপ এবং কোনো কোনো অংশ যান চলাচলের অনুপযোগী। পরবর্তী আরও (২৬৯.৭৬ কিলোমিটার থেকে) ৩০ মিটারের অবস্থা খারাপ ও খুব খারাপ বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে আরও কিছু অংশ খারাপ ও খুব খারাপ হওয়ায় এসব অংশে যানবাহন চলে ধীর গতিতে। সৃষ্টি হয় যানজট।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের হলেও কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু এখনও দুই লেনের। তাই সেতুর টোল প্লাজায় গত ঈদ মৌসুমে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট হয়েছে। এবারও একই ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন এই সড়কের নিয়মিত চালক ও যাত্রীরা। অবশ্য কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতুর পাশে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে।
গত ৯ মে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসড়কের যানজট নিরসন সংক্রান্ত সভায় জানানো হয়, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুর, মোগড়া ও মেঘনা টোল প্লাজায় যানজট হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সাইনবোর্ড মহাসড়ক সংলগ্ন খালি জায়গা ভরাট করে ঈদের আগেই 'বাস বে' নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এখনও মাটি ভরাটের কাজই শুরু হয়নি। শিমরাইলে সার্ভিস লেন ও বাস বে নির্মাণ এবং কাঁচপুরেও রাস্তা চওড়া করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া সওজের নারায়ণগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আলিউল হোসাইন সমকালকে জানান, এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে ঈদের আগে কাজ শেষ করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে।

উত্তরের পথেও আশঙ্কা : জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কের নির্মাণ কাজ গত মার্চে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এপ্রিল পর্যন্ত শেষ হয়েছে ৬৫ ভাগ কাজ। সম্প্রতি ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুনে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়, এই মহাসড়ক নির্মাণ চলমান থাকায় ঢাকা ইপিজেড, বিকেএসপি, কালিয়াকৈর সেতু ও এলেঙ্গা বাজারে যানজট হচ্ছে।
গত শুক্রবারও ৭০ কিলোমিটার এই মহাসড়কে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট হয়েছে। তবে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) আবদুস সালাম সমকালকে জানান, যানজট নিরসনে এরই মধ্যে সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহন মালিক-চালক ও যাত্রীদের দাবি, যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে খুব বেশি সুফল মিলবে না। হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, বৃষ্টি হলেই এ মহাসড়কে যানজট লেগে থাকে। ঈদে যানবাহনের চাপ বাড়লে জটও বাড়বে।

সিলেট, ময়মনসিংহ ও খুলনা সড়কেও যানজটের আশঙ্কা :ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা অংশে নিত্যদিনই দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়, গাজীপুরের তারগাছ এলাকায় বর্তমানে গাড়ির গতি ঘণ্টায় এক কিলোমিটারও নয়। বাস র্যা পিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের আওতায় মহাসড়কের দুই পাশে ড্রেন খোঁড়ায় যান চলাচলের জায়গা সরু হয়েছে। এতে যানজট হচ্ছে। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, মাত্র ১২ কিলোমিটার পাড়ি দিতে এখনই তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগছে। ঈদ মৌসুমে ভোগান্তি বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বৃষ্টির কারণে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া নারায়গঞ্জের ভুলতা এলাকায় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী চলতি মাসে ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ না হওয়ায় গাউছিয়া অংশে দিনভর যানজট লেগেই থাকছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কেও ভোগান্তির ভয় রয়েছে এবার ঈদে।

 

http://samakal.com/bangladesh/article/1806175