৪ জুন ২০১৮, সোমবার, ১১:৩৬

ফরিয়াদের মঞ্চ ফেসবুক

নির্যাতন, সরকারি অফিসে হয়রানি, বাসে অপ্রীতিকর ঘটনা- সবই এখন জায়গা করে নিয়েছে ফেসবুকে। শুধু নেগেটিভই নয়, পজিটিভ অনেক কিছু তুলে ধরছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। নিজ এলাকার সড়কের দুর্দশা, জনপ্রতিনিধির দাপটের কথাও থাকছে এতে। সব মিলিয়ে ফেসবুক যেন হয়ে উঠেছে একটি মঞ্চ। বিশেষ করে ফরিয়াদের মঞ্চ। এ ফেসবুককে ব্যবহার করেই অনেক অসহায় পরিবার পেয়েছেন সহায় সম্বল।

মৃত্যুপথ যাত্রীও পেয়েছেন চিকিৎসা সুবিধা। এমন হাজারো ফরিয়াদ প্রতিদিন ফেসবুক পেইজে ঝুলছে। সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়া সবুজ বিশ্বাসের ক্ষোভ ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম ১৬০০০ টাকা দিয়ে। এত টাকা ফি নিচ্ছে, কারো কি কিছু বলার নাই?

এই স্ট্যাটাসে লাইক পড়েছে ৩৪৮টি। কমেন্ট ৪৮ টি। সবুজ বিশ্বাস কেন আইনের আশ্রয় নিলেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কেন ঝামেলা মাথায় নিব।
কিছুদিন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে দেশজুড়ে। তার স্ট্যাটাসটি ছিল ‘শান্তিনগর মোড়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস পাইলাম না। হেঁটে গেলাম বাংলামোটর। বাংলামোটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাঁড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার তাই হলো। কলেজ ড্রেস পরা একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেসে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেসে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিছে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে এন্ড একটা বাস থামায়ে তাতে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফ্লি আসছি।’
একটি মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস নজর কেড়েছিল সবার। সেই ভাইরাল স্ট্যাটাসটি ছিল, ফার্মগেট থেকে টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। সেজান পয়েন্ট এর সামনে থেকে নিউ ভিশন বাস দেখে হাত তুল্লাম। বাস থামালো। বাসের সামনের হেডলাইটের জন্য বাহির থেকে সামনে বসে থাকা লোকগুলো দেখে মনে হয়েছিল বাস ভর্তি আছে। বাসে উঠে দেখলাম পিছনে পুরা ফাকা। অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বসলাম সিটে। না সামনে লোকগুলো তো আছে।

বসার পরেই উনারা ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে আর বলছে ‘বাস আসাদগেট দিয়া না লইয়া সংসদের রাস্তা দিয়া ঘুরা’। আমি দাড়ায়ে বললাম বাস ওইদিকে গেলে আমাকে মোড়ে নামায় দেন। কন্ডাক্টর গেটে হাত রেখে কিছুটা বাঁকা হুয়ে দারায় ছিল আর বল্লো আরে আপা ভয় পাইতাছে এই বলে বাসের সবাই হাসছিল। এর মধ্যে খামারবাড়ীর মোড় ঘুরিয়ে বাস সংসদের সাইডের রাস্তায়। আমি চিল্লায় বললাম বাস থামান নাইলে আমি পুলিশ কমপ্লেইন করব। এই বলায় ড্রাইভার বল্লো গেট লাগায় দে। কন্ডাক্টর যখন গেট আটকাবে আমি কোনো চিন্তা না করেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাস থেকে লাফ দিলাম। ব্যথা পেয়েছি হাতে কিন্তু পাশেই কতগুলো পুলিশ দেখে তাদের গিয়ে বললাম আপনারা নেক্সট সিগন্যালে খবর দেন যেন বাসটা ধরে। উনারা আমার হেল্প করার থেকে বাইক আটকে টাকা খাওয়াটা বেশি জরুরি মনে করেছিল। কথাই শুনে নাই আমার। হয়তো কালকের পেপারে আমার নাম থাকত। অথবা গুম হয়ে যেতাম।

তবে কী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর আস্থা হারানোর কারণেই আশ্রয় নিচ্ছেন ফেসবুকের? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা হারানোর কারণেই যে ফেসবুকে তথ্য যোগ করছেন তা নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য একটি প্রসেসের মাধ্যমে যেতে হয়। এবং এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফেসবুকের মাধ্যমে খুব সহযেই যোগাযোগ করতে পারছেন এবং এতে করে অধিকাংশ সময় দ্রুত অন্য ব্যক্তির দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত হচ্ছেন।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মানবাধিকারকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বিচার বিভাগের উপর আস্থা হারানো একটা কারণ। আরেকটা গুরত্বপূর্ণ কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে ভিকটিম একটি সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারছেন। তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে এটা সকলকে জানানোর মাধ্যমে তিনি সুরক্ষিত বোধ করেন এবং পরবর্তীতে আবারো বিপদ হবার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কমে যায়।

মানুষের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয় হতে কিংবা কোন নির্দিষ্ট পেইজের ভিউ বাড়াতে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অসত্য তথ্যও। এক নেশাগ্রস্ত মেয়ে তার বাবার বিরুদ্ধে ফেসবুক লাইভে তুলেছিল যৌন হয়রানির অভিযোগ। তার ফেসবুক লাইভের মর্মস্পর্শী কান্না লাখো লাখো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সত্য উদঘাটিত হতে সময় লাগে না বেশিদিন। পরে জানতে পারা যায় তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।

একটি উড়ো স্ট্যাটাস এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে, অধিকাংশ গণমাধ্যম তা নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল। স্ট্যাটাসটি ছিল মূলত একটি চিঠি। তার মূল বিষয় ছিল ম্যাজিট্রেট বৌয়ের কথায় মা’কে রেললাইনে ফেলে রেখে গেছেন ছেলে। খবরের সকলেই সূত্র দিয়েছিল ফেসবুক। পরে জানতে পারা যায় বিষয়টি পুরোটাই বানোয়াট।

ড. গোলাম রহমান আরো বলেন, ফেসবুুকে যেহেতু তথ্য একজন ব্যক্তিই দিচ্ছেন। আবার অন্যের এই তথ্যের সত্যতা যাছাইয়ের কোনো উপায় নেই তাই মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের (সাইবার ক্রাইম ইউনিট) সহকারী পুলিশ কমিশনার কিবরিয়া রহমান বলেন, ফেসবুকের কারণে যেমণ অনেক ঘটনা আমরা জানতে পারি। আবার অনেক সময় তথ্য ফাঁসের কারণে অনুসন্ধানে সমস্যায় পড়তে হয়। সেই সঙ্গে বানোয়াট তথ্যের সমস্যাতো আছেই।
ফেসবুক বর্তমান সময়ের অতি পরিচিত একটি মাধ্যম। ফেসবুকের দোয়া প্রার্থনা বহুল প্রচলিত একটি প্রথা। বিভিন্ন পরীক্ষার আগে দোয়া চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। বিয়ে, বাচ্চার জন্ম, ঘুরতে যাওয়া, আহত অবস্থা ইত্যাদি সময়ে দোয়া চেয়ে দেয়া হয় স্ট্যাটাস। রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ছড়াছড়ি। টেলিভিশনের মাধ্যমে জানলাম ফেসবুকের মাধ্যমে মিলছে এসব প্রশ্ন। কিন্তু আমার পরীক্ষার সময় পেলাম না। ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজে, গ্রুপে যোগাযোগ করলাম, টাকা দিতে চাইলাম কেউ রিপ্লেও দিলো না।

ফেসবুকে ফরিয়াদের মাধ্যমে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন অনেক ইউটিউবার। তারা তাদের মেধার জানান দিয়েছে ইউটিউবে আর তা ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। যেমন, সালমান মুক্তাদির, সোলায়মান সুখন, নায়লা নাঈম, টয়া, হিরো আলম।

স্বল্প সমসয়ে তারকা খ্যাতি পেতে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন অনেকে। যেমন- টুনটুনি আদ্রিতা (হাতিপু নামে পরিচিত), নিশির কণা (তাম্মাক সিঙ্গার), আলি জি স্টার ও রাইসুল (র্যা পার) ইত্যাদি। আবার নেশাগ্রস্ত্র জুনায়েদ বন্ধুকে আঘাতের দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় যেতে হয়েছে জেলে।
ফেসবুকে অত্যন্ত কার্যকর একটি ফরিয়াদ হচ্ছে রক্তের আবেদন ও সাহায্যের আবেদন। ফেসবুকে রক্তের জন্য রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ কিংবা ব্যক্তিগত ওয়ালে দিলেও সহযেই মিলছে রক্ত। ফেসবুকে এক সপ্তাহ আগে একটি গ্রুপে একব্যাগ এ পজেটিভ রক্তের জন্য আবেদন করেন আদনান আসিফ। তিনি বলেন, আমার বোনের অস্ত্রোপচারের জন্য এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল তা আমি পোস্ট দেয়ার ঘণ্টাখানিকের মধ্যে পেয়ে যাই। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার রাইসুল আসাদ। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলেটি সহ কয়েকজন সহপাঠীর ছিল না এসএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা। ফেসবুকের একটি গ্রুপের মাধ্যমে আসাদ সাহায্যের আবেদন করলে ফরম ফিলাপের পাশাপাশি কিছু টাকা দরিদ্র তহবিল ফান্ডেও জমা হয়।

ফেসবুক ফরিয়াদকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছিলেন আহসান হাবিব পেয়ার নামে এক ব্যক্তি। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে মানুষের দুঃখ কষ্টের চিত্র তুলে ধরতেন। ক্যামেরার সামনে করতেন লোক দেখানো সহযোগিতা। তারপর ফেসবুকে ফরিয়াদ করতেন উক্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। এভাবে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। একটি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে তার ভণ্ডামীর আসল চিত্র। গ্রেপ্তার হন তিনি।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=120181