৪ জুন ২০১৮, সোমবার, ১১:৩৪

চার লেন সড়ক নির্মাণ ব্যয় বাংলাদেশে বেশি

ঢাকা-সিলেট কিমি. ৫৩.২২ কোটি টাকা ; ভারতে কিমি. ব্যয় ১০ কোটি টাকা ; চীনে গড়ে কিমি. ১৩ কোটি টাকা

চীন ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে চার লেন সড়ক নির্মাণব্যয় অনেক বেশি। আবার বাংলাদেশের মধ্যেই ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের ব্যয়ের চেয়ে ঢাকা (কাঁচপুর)-সিলেট মহাসড়ক চার লেন নির্মাণব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে করতে ব্যয় হচ্ছে প্রতি কিলোমিটারে ৫৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, ভারতে এই ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। আর দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না করা, প্রকল্প বাস্তবায়নে আনুসঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণব্যয় সবচেয়ে বেশি বলে বিশ্বব্যাংক ২০১৩ সালের এক জরিপে বলছে।

সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য ১১ হাজার ৪১১ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার টাকা ব্যয়ের একটি বড় ব্যয়ের প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সেখানে ২১৪ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৫৩ কোটি ২১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। প্রকল্পের মাধ্যমে চার লেন করা, বাঁক সরলীকরণ করা, শিল্প-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে এশিয়ান হাইওয়েতে নেটওয়ার্ক, বিমসটেক করিডোর, সার্ক করিডোরসহ আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কাজ ত্বরান্বিত করা হবে। এই প্রকল্পে নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৮ কোটি ৫ লাখ টাকা। ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২১৪.৪৪ কিলোমিটার রাস্তা পেভমেন্ট, ২ কোটি ২৭ লাখ ৪ হাজার ৫৫৮ ঘনমিটার মাটির কাজ, রেলওয়ে ওভারপাস, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। পাঁচ বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতি বছর এই প্রকল্পের জন্য এডিপিতে বরাদ্দ রাখতে হবে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে ৯৮৬ দশমিক ৪৭৬ একর। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ২৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এখানে প্রতি একর জমির দর পড়ছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

বিশ্বব্যাংক ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রতিক্রিয়ার সময় বলেছিল, বাংলাদেশে প্রকল্প প্রণয়নের সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয় ধরা হয়, পরবর্তী সময়ে সেই ব্যয় আর ঠিক থাকে না। সেটা বাড়ানো হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুর্নীতি। আর এভাবেই বাড়ে প্রকল্পের ব্যয়। এ কারণে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশ।
ভারতের এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ ব্যয় যুক্ত করে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় গড়ে ৮ থেকে ৯ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশের মুদ্রায় সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ কোটি টাকা। আর চীনের (২০১০-১৫) ১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট এক সমীক্ষা অনুযায়ী, সেখানে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় ১৬ থেকে ১৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা। তবে দুই লেনের মহাসড়ক চার লেন করতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১০ কোটি টাকার কম।

বিশ্বব্যাংক তাদের ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে বাংলাদেশী মুদ্রায় কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ২৮ কোটি টাকা। পাশের দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় ধরা হচ্ছে কিলোমিটারপ্রতি গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ইন্দ্রপুল হতে চক্রশালা পর্যন্ত বাঁক সরলীকরণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ব্যয় ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা হওয়ার কথা নয়।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো উইং বলছে, গড়ে প্রতি বছর এই প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। স্থানীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে প্রকল্পটির ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানো যেতে পারে। এই প্রকল্পের জন্য ১০টি জিপ গাড়ি, ১৩টি পিকআপ, ১৯টি ম মোটরসাইকেল, ২টি মাইক্রোবাস কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দর বাইপাস ইন্টারসেকশন-লালবাগ-সালুটিকর-কোম্পানিগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণের চলমান প্রকল্পে একটি জিপ, ২টি ডাবল ক্যাবিন পিকআপ রয়েছে। সিলেট জোনের সড়কের অন্য একটি প্রকল্পে একটি জিপ ও চারটি ডাবল ক্যাবিন পিকআপ কেনার সুপারিশ রয়েছে। তাই এই প্রকল্পে যানবাহন কেনার সংখ্যা কমানো উচিত। প্রকল্পে অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৫ কোটি টাকা, যা দিয়ে একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সড়ক প্রকল্প নিয়ে আলাপকালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা বড় সমস্যা। জমি অধিগ্রহণ ও এর মূল্য পরিশোধে দুর্নীতি হয়। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ কাজও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম দুর্নীতি হয় জমি অধিগ্রহণে। সেখানে জমির মালিককে কম মূল্য দিয়ে বেশি মূল্য সরকারকে দেখানো হয়। তার মতে, টেন্ডারে প্রতিযোগিতা না থাকায় সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের জন্য মালামাল কেনার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হয়। এ ছাড়া এ দেশে কোনো প্রকল্পই সময় মতো শেষ হয় না। ফলে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যয়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/322663