৩ জুন ২০১৮, রবিবার, ৯:১৬

ঢাকার রাস্তায় বিকারহীন চালক, জিম্মি যাত্রীরা

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। শুধু তাই নয়, কারো যাচ্ছে হাত, কারো পা। যারা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বেঁচে যাচ্ছেন, তারা বেঁচে থেকেও মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছেন। কিন্তু যাদের জন্য এ বিভীষিকা সেই চালকদের নেই কোনো অনুশোচনা। বিকারহীন, নির্বিকার তারা। সম্প্রতি রাজধানীতে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন কয়েকজন।
অনেকেই হাত পা হারিয়ে হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলো ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছে।

এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই খবর আসছে। তবে, চালকরা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন পথচারী ও যাত্রীদের। আর সড়ক দুর্ঘটনা ও যাত্রীদের কল্যাণে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মনোবিজ্ঞানীদের মতে নানা চাপের কারণে অনেক চালকেরই মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও জীবনবোধ সম্বন্ধে খুব বেশি ধারণা নেই। নানা কারণে তাদের মানসিকতা বিকৃত হয়ে যায়। আর দুর্ঘটনা ঘটালেও বিচারহীনতার কারণে তারা পার পেয়ে যায়। এতে করে দুর্ঘটনা ঘটলেও তাদের মনে তা রেখাপাত করে না। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স নয়, চালকদের নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনেই এটি করতে হবে।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের বাস, লেগুনা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানচালক ও তাদের সহকারীদের সঙ্গে কথা বললে তারা প্রায় সবাই এসব দুর্ঘটনার জন্য পথচারী ও যাত্রীদের দোষারোপ করেন। যেসব চালক ও তাদের সহকারীদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই নিকট অতীতে ছোট বড় দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আবার এসব দুর্ঘটনায় পরিবহন চালক ও তাদের সহকারীদের কারো কারো মনে কিছুটা রেখাপাত করলেও দ্রুতই তারা ঘটনা ভুলে যান।

যাত্রাবাড়ী থেকে টঙ্গীতে যাতায়াতকারী তুরাগ পরিবহনের বাসচালক পলাশ জানান, প্রায় একযুগ ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। তার দাবি পথচারী কিংবা যাত্রীদের দোষেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। সম্প্রতি কাওরানবাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের পাল্টাপাল্টিতে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রাণ হারানো রাজীব হাসানের দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তার (রাজীব) দোষেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য পলাশ নামের এই চালক স্বীকার করেন বেশি ট্রিপের আশা এবং নিজেদের মধ্যে বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে বাস চালকদের মধ্যেও পাল্টাপাল্টি অনেক বেড়েছে। এজন্য দুর্ঘটনাও বাড়ছে। আলাপকালে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলেও তাদের তেমন কিছুই হয় না।

দুর্ঘটনার পরই নিহত বা আহতদের স্বজনদের সঙ্গে মালিকপক্ষ আপসের ব্যবস্থা করে ফেলে। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী ৮ নম্বর বাসের চালক লাল মিয়ার সঙ্গে কথা হয় যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। তিনি বলেন, মানুষ এখন গাড়িরে ডরায়না। কানে মোবাইল লাগাইয়া কথা কইতে কইতে রোড পার হয়। আমরার তহন কি করার আছে। আমরার সমস্যা হয়। পরিস্থিতি ঠিক থাকে না। এক্সিডেন্ট হইয়া যায়।’ তার ভাষায় ‘রাস্তায় গাড়ি চললে টুকটাক এক্সিডেন্ট হইবোই।’ ৮ নম্বর বাসের অন্য এক চালক সোহেল বলেন, আগে দুর্ঘটনা এত বেশি ছিল না। কিন্তু কিছুদিন ধরে বেশি ঘটছে। ড্রাইভারদেরও দোষ আছে। পথচারী ও যাত্রীদেরও দোষ আছে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। কিন্তু মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মালিকরা তখন সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে ফেলে। তিনি স্বীকার করেন চালকদের মধ্যে অনেকেই মাদক গ্রহণ করে গাড়ি চালান। এতে করে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

মিরপুর-১ নম্বর থেকে মতিঝিলগামী ‘নিউ ভিশন’ পরিবহনের চালক মো. স্বপন মিয়া বলেন, দোষ কম বেশি সবারই আছে। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য পথচারী ও যাত্রীদের দোষ বেশি। তাদের অনেকেই সচেতন না। আর ড্রাইভারদের মধ্যে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা আছে। যে কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত ১২ই এপ্রিল রাজধানীর ফার্মগেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুনির পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাস। স্বপন মিয়া জানান সেই বাসের চালক তার শ্বশুর মো. আব্দুল মোতালেব।

এই মামলায় বর্তমানে মোতালেব কারাগারে রয়েছেন। ১৯ বছর বয়সী তানভীর হোসেন গুলিস্তান টু ডেমরা রুটে গাড়ি চালান প্রায় দেড় বছর ধরে। গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় চার মাস আগে টিকাটুলী এলাকায় একটি রিকশা তাকে সাইড না দেয়ায় ওই রিকশাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন তিনি। এতে করে রিকশা আরোহী ও রিকশাচালক আহত হন। এ ছাড়া বেপরোয়াভাবে চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার সড়কের আইল্যান্ডের ওপর গাড়ি তুলে দেয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি। তানভীর জানান, তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বলেন, এই রুটে (গুলিস্তান টু ডেমরা) চলাচলকারী আসিয়ান পরিবহনের অনেক গাড়ির চালকেরই লাইসেন্স নেই। অনেকে লাইসেন্স নবায়ন না করেই বাস চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কোনো কোনো চালক জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করে গাড়ি চালাচ্ছেন। এতে তাদের কিছু হয় না বলেও জানান তিনি। তানভীর বলেন, মাঝেমধ্যে পুলিশ ধরলে ম্যানেজ করে নিই। মালিকেরাও ম্যানেজ করে ফেলেন। মিরপুর-১২ থেকে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে চলাচলকারী বিকল্প অটো পরিবহনের চালকের সহকারী নাজিম (২২)। বছরখানেক আগে ভোলার চরফ্যাশন থেকে কাজের উদ্দেশ্যে আসেন ঢাকায়। কাজ শুরু করেন চালকের সহকারী হিসেবে। সংশ্লিষ্ট গাড়ির চালক সবুজ মিয়া প্রসঙ্গে নাজিম বলেন, ‘আমার ডেরাইভারের খুব জিদ। অন্য গাড়িকে সাইড দিতে চায় না। উনি ডেরাইভার হিসেবে ভাল। কিন্তু রাগটা একটু বেশি। মাঝে মাঝে অন্য গাড়ির লগে লাগাইয়া দেয়’।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, সড়কের বর্তমান অবস্থাটি আমাদের বাস্তব চিত্র। চালক ও তাদের সহকারীদের নৈতিকতা, মূলবোধ ও জীবনবোধের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলার জন্য তাদের নৈতিক ও জীবনবোধের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এ নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগও নেই। দেশ হিসেবে আমরা যতটুকু এগিয়ে যাচ্ছি, পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিনই মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যা সামাধানে জোরালো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, চালকরা নানা কারণে চাপে থাকেন। কখনো পুলিশের পিটুনি, কখনো যাত্রী ও পথচারীরাও নানা কারণে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। এতে করে তাদের সুস্থ মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। সব মিলিয়ে তাদের পরিবেশও খুব একটা অনুকূল নয়। যে কারণে দুর্ঘটনার পরও তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এক্ষেত্রে যাত্রী ও পথচারীদেরও সচেতনতার প্রয়োজন বলে মনে করেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, বিচারহীনতার কারণে চালকদের মধ্যে কোনো বিকার নেই। চালকরা জানে যে দুর্ঘটনা ঘটালেও তারা পার পেয়ে যাবে।

এজন্যই ওরা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। মানসিকতা ভোঁতা হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার জন্য দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তবেই দুর্ঘটনা কমে আসতে পারে। নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, মূল্যবোধের শিক্ষা জন্ম থেকেই হয়ে আসে। তারা পারিপার্শ্বিকতা যা দেখে ওই মূল্যবোধকেই তারা ধরে রাখে। সবার আগে মূল্যবোধকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, কাউকে যখন সীমা রেখার শেষ মাথায় পৌঁছে দেয়া হয়, তখন স্বভাবতই তার মানসিকতা আসলে সেভাবে কাজ করে না। চালক ও সহকারীদের যারা নিয়োগ করেন এবং যে কর্মপদ্ধতি তা নিয়ম অনুযায়ী করা দরকার। তাদের একটানা তিন দিন, সাত দিন ডিউটি করা- এগুলো বন্ধ করা দরকার। তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং বিশ্রামের জন্য টার্মিনালগুলোতে জায়গা রাখা দরকার। অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এখানে সার্বিক একটা উন্নতি প্রয়োজন। চালক ও তাদের সহকারীদের জন্য লাইসেন্স প্রাপ্তি, তাদের ট্রেনিং, থিয়োরিটিক্যাল ধাপ এগুলো ভালোভাবে পার হতে হবে। ভাল ট্রেনিং হলে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা এমনিতেই আসবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=120063