৩ জুন ২০১৮, রবিবার, ৯:১৫

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধের আড়ালে চলছে রাজনৈতিক হত্যা

বাংলাদেশে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে কথিত ‘যুদ্ধ’ শুরু করেছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে এই ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’কে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে।
অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর ‘অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ (ইউএনওডিসি) বলেছে, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে এবং মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানবাধিকারভিত্তিক কৌশল অবলম্বনের জন্য সব সদস্য দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
‘আড়ালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’

লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফে বাংলাদেশের মাদকবিরোধী যুদ্ধের ওপর যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে তার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ ড্রাগস ওয়ার ইউজড টু হাইড পলিটিক্যাল অ্যাসাসিনেশনস’। অর্থাৎ বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আড়াল করতে মাদকবিরোধী লড়াইকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন টেলিগ্রাফের তিন সাংবাদিক বেন ফার্মার, সুজানা স্যাভেজ ও নিকোলা স্মিথ।
চট্টগ্রামে হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিবেদনটি। তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের একজন কর্মী।
র্যাব দাবি করেছে যে, হাবিবুর রহমান বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী হাবিবুর রহমান একজন মাদক কারবারি। চট্টগ্রামে তিনি ও তার সহযোগীরা যখন তাদের গোপন আস্তানায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন, তখন তারা পুলিশের দিকে গুলি চালান। সেই বন্দুকযুদ্ধে হাবিবুর রহমান মারা যান।
কিন্তু হাবিবুর রহমানের পরিবার টেলিগ্রাফকে জানিয়েছে, পুলিশের ভাষ্য একেবারেই বানোয়াট। হাবিবুর রহমানকে সাদা পোশাকের পুলিশ স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে বেরুনোর পর নিয়ে গেছে।
তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি, টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, ‘মসজিদ থেকে বেরুনোর পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পুলিশ হেফাজতে তাকে হত্যা করা হয়।’
এই আত্মীয়কে উদ্ধৃত করে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সে মাদক কারবারি বা মাদকাসক্তÑ কোনোটাই নয়। সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িত হওয়ায় এবং জমি নিয়ে প্রতিবাদ জানানোর কারণেই তাকে এ ঘটনার শিকার হতে হলো।’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াকে উদ্ধৃত করেছে টেলিগ্রাফ, যিনি দাবি করেছেন এই মাদকবিরোধী যুদ্ধের সাথে মাদক ব্যবহার বন্ধের সম্পর্ক খুব সামান্যই।
‘এ বছরের শেষ নাগাদ যে নির্বাচন হওয়ার কথা, এটি সম্ভবত তার আগে ভয়ভীতি দেখানোর একটি কৌশল।’ তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এ রকম হত্যা তত বাড়বে।
নজর রাখছে জাতিসঙ্ঘ
এ দিকে জাতিসঙ্ঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর ইউএনওডিসি এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।
বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে বহু মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যম এবং সিভিল সোসাইটির তরফ থেকে বিভিন্ন অনুসন্ধানের জবাবে তারা এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে ইউএনওডিসি।
এতে তারা বলেছে, ‘পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সব সদস্য রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাই, যেন তারা মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানবাধিকারভিত্তিক কৌশল অবলম্বন করে। এ বিষয়ে যে তিনটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন আছে, সেগুলো মেনে চলে।’
এর আগে লন্ডনের আরেকটি সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের মাদকবিরোধী যুদ্ধকে ফিলিপাইনের সাথে তুলনা করে বলেছিল, এর ফলে দেশজুড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ’স ফিলিপিন্স-স্টাইল ড্রাগস ওয়ার ক্রিয়েটিং ‘এটমোসফিয়ার অব টেরর।’
বাংলাদেশে এই মাদকবিরোধী অভিযানে বিনা বিচারে হত্যার অভিযোগ নিয়ে গত ক’দিন ধরে তীব্র সমালোচনার মুখে আছে সরকার।
টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেখানকার পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো: একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রেকর্ড করা অডিও প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল হয়।
দেশটির কিছু সংবাদমাধ্যমে এই অডিও রেকর্ডের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারের টেকনাফে গত ২৬ মে হক নিহত হন।
তাকে বাসা থেকে র্যাব এবং ডিজিএফআইর স্থানীয় দু’জন কর্মকর্তা ডেকে নেয়ার পর হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। কিন্তু র্যাব বলেছে, প্রকাশ হওয়া অডিও খতিয়ে দেখছে বাহিনীটির সদর দফতর।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের অন্যান্য ঘটনার মতো এই ঘটনাও তদন্ত করা হবে।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেখুন ওই অডিও আমি শুনিনি। আমি না দেখে তো বলতে পারব না যে, কী অডিও বের হয়েছে। এটা আমরা সব সময় বলছি, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অন্যায়ভাবে কিছু করে থাকে, তার তো একটা ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল এনকোয়ারি হচ্ছে এবং হবে। সেখানে কেউ দোষী প্রমাণ হলে তারও বিচার হবে। সেটা আমরা সব সময় বলে আসছি। কিন্তু এটা অডিও না দেখে আমি বলতে পারব না।’

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/322377