২ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:৩৭

প্রয়োজননেই, তবুচলছেযেসরকারিদপ্তর

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রথমটি সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দ্বিতীয়টি বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখভাল করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারি দেশের সব রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশে এখন আর কোনো রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তবুও চলছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বিলুপ্ত হলেও 'বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটে'র কার্যক্রমও চলছে। প্রয়োজন না থাকলেও সাড়ে চার বছর ধরে এই ইউনিটের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক রকম অলস সময় পার করছেন। তাদের বেতন-ভাতা, পরিবহন ও দাপ্তরিক ব্যয়, আপ্যায়ন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মাসে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

রাজধানীর আবদুল গণি রোডে শিক্ষা ভবনের পঞ্চম তলায় ফ্লোরজুড়ে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সংস্থাটিতে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ছয়তলা এই ভবনের পাঁচটি ফ্লোরেই রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অফিস। জায়গার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে মাউশির দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

জানা গেছে, সরকার সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে এবং নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ১৯৯০ সালে 'বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন' পাস হয়। এ আইনের অধীনে প্রথম পর্যায়ে ১৯৯২ সালে প্রতি জেলার একটি করে থানায় পরীক্ষামূলকভাবে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৯৩ সালে সারাদেশে তা সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে আইনটি কার্যকর করা হয়। ১৯৯৫ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কথা বলা হয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এরই মধ্যে সরকারের এই ইউনিটের লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি এখন প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হারও কম। এ জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিটের আর প্রয়োজন নেই বলেও সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই ইউনিটের মূল কাজ ছিল বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) প্রদান করা। সরকার ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি দেশের সব রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কাজ শেষ হয়ে যায়। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ে এই ইউনিটের প্রায় অর্ধশত কর্মী, যাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পদায়ন করা হয়েছিল।

ওই ইউনিটের দু'জন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, 'সব বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার পর স্বাভাবিক কারণেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম, আমাদের মূল কর্মস্থল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) চাকরি ন্যস্ত করা হবে। কিন্তু সাড়ে চার বছরেও তা হয়নি। কারণ, এখানে অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিবের ১০ থেকে ১১টি পদ রয়েছে। কাজ না থাকলেও এসব পদে বারবার কর্মকর্তারা পদায়ন পাচ্ছেন। তারাও প্রায় অলস সময় পার করছেন, আমরাও বসে বসে চাকরি করছি।'

সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের প্রধান হলেন মহাপরিচালক। এ ছাড়া পরিচালকের তিনটি পদ, উপপরিচালকের সাতটি ও সহকারী পরিচালকের দুটিসহ মোট ৫৫টি পদে ৫০ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে মহাপরিচালকের পদটি যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার হলেও এই পদে বর্তমানে কর্মরত আছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। আর উপসচিব পদমর্যাদার পরিচালকের তিনটি পদের মধ্যে দুটিতে কর্মরত আছেন একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব।

এই ইউনিটের মহাপরিচালক এ কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, 'এটা ঠিক যে এমপিওভুক্ত সব রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ায় আমাদের মূলত এখন আর কোনো কাজ নেই। এ জন্য আমরা নিজ উদ্যোগেই সারাদেশের জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করি। আমরা বছরে টার্গেট করে ৩৬০টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করি। রমজান মাসে ও বার্ষিক পরীক্ষার কারণে ডিসেম্বরে পরিদর্শন কার্যক্রম বন্ধ থাকে।'

তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস ডিপিইর অধীনে। এগুলো পরিদর্শনের দায়িত্বও ডিপিইর। বিদ্যালয় ও শিক্ষা অফিস পরিদর্শনের দায়িত্ব বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটকে দেওয়া হয়নি। তারা নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয় পরিদর্শনের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করছেন।'

আনোয়ার হোসেনও স্বীকার করেন, এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো জাতীয়করণ হওয়ার কারণে ২০১৩ সাল থেকে ওই সব স্কুলে ভবন নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ প্রায় সব কাজই ডিপিইর অধীনে চলে গেছে। তবে তিনি বলেন, 'আমরা এখন বিভিন্ন কারণে জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া স্কুল ও শিক্ষকদের করা মামলাগুলো মোকাবেলা করছি। এ ছাড়া যারা জাতীয়করণের আওতায় আসতে পারেননি, তাদের কল্যাণ তহবিলের (বেসরকারি শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট) টাকা দিচ্ছি।'

http://samakal.com/bangladesh/article/180651