২ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:৩৫

পাঁচ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা ২২২

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২২২ জন। এর মধ্যে মে মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৪৯ জন। গতকাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৮ জন। গুলিতে একজন। ফেব্রুয়ারিতে ক্রসফায়ারে ছয় ও গুলিতে একজন।

মার্চে ক্রসফায়ারে ১৭ ও নির্যাতনে একজন। এপ্রিলে ক্রসফায়ারে ২৮ এবং নির্যাতনে একজন। পেছনে তিন মাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে মে মাসে। মে মাসে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৪৭ এবং নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছেন দুজন। ১৫ই থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ১২৭ জন ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে বলে দাবি করেছে অধিকার। র্যা ব ও পুলিশের দাবি নিহতরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু কিছু কিছু নিহতের স্বজনরা বলেছেন যে, নিহত ব্যক্তি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামে হাবিবুর রহমান নামে এক সবজি বিক্রেতাকে ভুলক্রমে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। এছাড়া নেত্রকোনায় আমজাদ হোসেন নামে এক ছাত্রদল কর্মীকে ও ঝিনাইদহে রফিকুল ইসলাম নামে এক যুবদল নেতাকে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে বিএনপি দাবি করেছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাসমূহের সমালোচনার মধ্যেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দাবি করেছে যে, মাদক ব্যবসায়ীদের দুপক্ষের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। কিন্তু যেখানে মাদকবিরোধী এই অভিযানের নামে হত্যাযজ্ঞ চলছে এবং ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে এবং মাদক ব্যবসায়ীরা নিজ এলাকা থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার খবর বের হয়েছে, সেখানে মাদক ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে নিহত হওয়ার বিষয়টি প্রচার করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি নতুন ধরনের কৌশল বলে দাবি অধিকারের।

অধিকারের তথ্যানুযায়ী মে মাসে র্যা ব, পুলিশ, ডিবি পুলিশ এবং কোস্ট গার্ডের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৪৯ জন। তাদের মধ্যে ১৪৭ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এছাড়া এসময়ে পুলিশ ও ডিবি পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছেন দুজন। নিহত ১৪৯ জনের মধ্যে একজন যুবদল নেতা, একজন ছাত্রদল কর্মী, একজন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা)’র নেতা, একজন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, একজন নিরাপত্তাকর্মী, একজন সবজি বিক্রেতা, তিনজন হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি, দুজন বিভিন্ন মামলার অভিযুক্ত আসামি এবং ১৩৭ জন কথিত অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ী।

অধিকার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ৯ই মে রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকার বাড্ডায় অবস্থিত জাগরণী ক্লাবের ভেতরে আব্দুর রাজ্জাক বাবু নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী সাফায়াত তামরিন রনি নামে এক যুবককে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রনি নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল ব্যক্তিকে আড়াল করতে পুলিশ ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে রনিকে হত্যা করেছে বলে নিহত বাবুর স্বজনরা ধারণা করছেন। গত ১৭ই মে গভীর রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ এলাকায় র্যা ব-৫ সদস্যদের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবদুল আলীম নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যা ব বলেছে, আবদুল আলীম শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। আবদুল আলীমের স্ত্রী মতিয়ারা বেগম জানান, গত ১৭ই মে রাতে তার স্বামী চায়ের দোকানে চা পান করার সময় সাধারণ পোশাকে থাকা কয়েক ব্যক্তি তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। গত ২১শে মে টঙ্গীতে রিয়াজুল ইসলাম নামে একজন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এদিকে রিয়াজুলকে ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে তার পরিবারের কাছ থেকে দুই দফায় পুলিশ আট লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভিকটিমের মা পারভীন বেগম বলেন, তারা একটি সাদা কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয়ার পর আমার ছেলেকে ছেড়ে দেয়। পরবর্তীকালে টঙ্গী থানার এএসআই আবু বক্কর সিদ্দিকী রিয়াজুলকে পুনরায় আটক করে আরো এক লাখ টাকা দাবি করে। যখন তার স্বামী টাকা আনতে যান তখন তারা জানতে পারেন যে রিয়াজুল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। এই ঘটনা তদন্তে পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্বল ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাকারীদের দায়মুক্তির সুযোগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত মূল অপরাধীকে আড়াল করার জন্যও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=119903