২ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:২৯

আবার বিতর্কে নৌপরিবহন অধিদফতর

মান নির্ধারণ ছাড়াই নকশা অনুমোদনের উদ্যোগ

নৌযানের নকশা অনুমোদন পেতে কী যোগ্যতা বা শর্ত পূরণ করতে হবে তার আধুনিক কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করেনি নৌপরিবহন অধিদফতর। এ অবস্থায় আবারও নৌযানের নকশা অনুমোদনের উদ্যোগ নিয়েছে এ সংস্থাটি।

নকশা অনুমোদনে ঘুষ লেনদেনে পরপর দু’জন প্রধান প্রকৌশলী দুদকের হাতে গ্রেফতারের পরও এ কার্যক্রমে প্রক্রিয়াগত বড় কোনো পরিবর্তন না এনে পুরনো পথেই হাঁটছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকভাবে ২৯৪টি নৌযানের নকশার তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই ঘুষসহ আটক বিতর্কিত প্রধান নৌ-প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকার সময়ে জমা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওইসব নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

এ ছাড়াও রাজনৈতিক ও বিভিন্ন মহলের নানা ধরনের তদবির গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়ার তালিকায় কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির সুপারিশও রয়েছে। নতুন পুরো বিষয়টি নিয়ে নৌসেক্টরে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। নৌযান সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নকশা অনুমোদনের গাইডলাইন না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নৌ-পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, বছরে ২২০টি মালবাহী নৌযানের নকশা অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। অথচ আবেদন জমা পড়ছে দুই বা তিন হাজার। কোন প্রক্রিয়ায় অনুমোদন দেব তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার আমরা দুটি পৃথক কমিটি করেছি। একটি কমিটি নাম্বার দিয়ে শর্টলিস্ট তৈরি করবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। পরে তা কারিগরি কমিটিতে পাঠানো হবে। এভাবে নকশা অনুমোদন করা হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নৌযান তৈরির আগে নকশা অনুমোদন নেয়ার আইনত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নৌপরিবহন অধিদফতরে নিবন্ধিত ডিজাইন হাউসের মাধ্যমে নকশা জমা হয়। কিন্তু যে সংখ্যক নকশা অনুমোদনের জমা হয় তা নানা কারণ দেখিয়ে পাশ করেনি নৌপরিবহন অধিদফতর।
আবার নকশা জমা দেয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে সংস্থাটির কয়েক কর্মকর্তা বাঁধা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদফতর বিভিন্ন সময়ে তাদের পছন্দমতো নির্দেশনা জারি করে ওই আলোকে নকশা অনুমোদন করেন। এবারও বাছাই কমিটিকে ৯টি শর্ত জুড়ে দিয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।

এর আগে আরেকটি অফিস আদেশে মন্ত্রী, এমপিসহ প্রভাবশালীদের সুপারিশ আমলে নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে চাপের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব নানা জটিলতার কারণে নকশা অনুমোদন পেতে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হন নৌযান মালিকেরা।
বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক যুগান্তরকে বলেন, নকশা অনুমোদনে কোনো ঘুষ দেয়ার কথা নয়। কিন্তু নৌযান মালিকদের ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে নকশা অনুমোদন করাতে হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে নৌপরিবহন অধিদফতরের সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই।
এ সংস্থাটিতে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। নকশা অনুমোদন নিয়ে ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা যোগসাজশ করে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেনদেন করে নকশা অনুমোদন করাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে চিঠি দিয়ে অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটিকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি।

আরও জানা গেছে, এবার নকশা অনুমোদনের জন্য ২৯৪টি একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে নৌপরিবহন অধিদফতর। এর মধ্যে ২৪৩টি মালবাহী জাহাজ, ১৫টি যাত্রীবাহী, আটটি তৈলবাহী এবং ২৮টি টাগ, বার্জ ও ড্রেজার জাতীয় নৌযান। কয়েকটি নৌযানের নকশা অনুমোদনে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, আবদুল লতিফসহ কয়েকজন এমপির সুপারিশ রয়েছে।
এ তালিকায় রয়েছেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ছাত্রলীগ নেতাসহ কয়েকজন রাজনীতিক ও ব্যবসায়িক নেতা। বেশ কিছু নৌযানের নকশার মালিক হিসেবে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের নাম রয়েছে। এতে আরও দেখা গেছে, মালবাহী ২৪৩টি জাহাজের মধ্যে ৫২টি জমা পড়েছে মেটা সেন্টার নামের ডিজাইন হাউসের মাধ্যমে।

এ ছাড়া ওশান শিপ ডিজাইন হাউসের মাধ্যমে ২৫টি, মাউন্ট ভ্যালির ২৪টি, বেঙ্গল মেরিনের ২২টি, লাকি মেরিন হাউসের নামে ১৯টি নকশা জমা পড়েছে। বাকি ডিজাইন হাউসগুলোর প্রত্যেকটির নামে ১০টির কম নকশা জমা পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মালবাহী জাহাজের নকশা অনুমোদন নিতে বড় লেনদেন হয়ে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌ-পরিবহন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত যেসব নকশা জমা পড়েছে সেগুলো যাচাই বাছাই করছেন।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১২০ থেকে ১৫০টির মতো নকশার স্বপক্ষে উপযুক্ত দলিলাদি পেয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, এতেই প্রমাণিত হয়েছে, এ তালিকায় অনেক জালিয়াত নকশা রয়েছে। এগুলো অনুমোদনের পর মোটা অঙ্কের টাকায় হস্তান্তর করা হবে। বিগত দিনে এমন ঘটনা ঘটেছে বলেও জানান তিনি।

একটি ডিজাইন হাউসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেভাল আর্কিটেক্ট বলেন, নৌপরিবহন অধিদফতর রহস্যজনক কারণে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত যেসব নকশা জমা পড়েছে সেগুলো তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে ঘুষের টাকাসহ আটক এসএম নাজমুল হক গত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদে ছিলেন। ওই সময় জমা পড়া বেশির ভাগ নকশাই তার পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।
কারণ নকশার জন্য নামকরণের ছাড়পত্র নেয়া ও নকশা জমা দেয়ার কাগজপত্রে এসএম নাজমুল হক নিজেই স্বাক্ষর করার পর তা জমা নেয়া হতো। ওইসব নকশাই পাস করার জন্য এখন তৎপরতা চলছে। তিনি এ পর্যন্ত যত নকশা জমা পড়েছে তা বিবেচনায় নেয়ার দাবি জানান।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/55346