১ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৯

পাঁচ কূপ খননে ৬শ’ কোটি টাকা পানিতে

ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ (থ্রিডি সার্ভে) নিয়ে নানা প্রশ্ন * গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান নিয়ে চলছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

দক্ষ জনবল, অপরিকল্পিত সাইসমিক জরিপ ও খননের কারণে ৫টি বড় কূপ থেকে গ্যাসের নাগাল পায়নি বাপেক্স (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড)। এই ৫টি কূপ খনন ও জরিপে কমপক্ষে ৬শ’ কোটি টাকার বেশি অর্থ পানিতে গেছে। কূপগুলো হল কৈলাশটিলা ৭, রশিদপুর ১০ ও ১২, সালদা ৪ ও সালদা (পুনর্বাসন) ১ নং কূপ। গড়ে প্রতিটি কূপ খননে ৮০ থেকে ১২০ কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে। তবে এ পর্যন্ত বাপেক্স ২৮টি কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলোতেই গ্যাস পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ৪টি ড্রিলিং রিগ কিনেও ৫ বছরে বাপেক্স বড় কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। এই সময়ে রিগগুলো দিয়ে বাপেক্স খনন করেছে মাত্র ৬টি কূপ। অথচ দেশে একই সময়ে অপর একটি বিদেশি কোম্পানি ৩টি রিগ দিয়ে খনন করেছে ১৭টি কূপ। জানা গেছে, চরম অযতœ-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর লুটপাটের কারণে ইতিমধ্যে বাপেক্সের মূল্যবান ৪টি রিগ নষ্ট হওয়ার পথে।
সম্প্রতি বাপেক্স নিয়ে একটি বিদেশি সংস্থার এক প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। কোম্পানিটি তাদের একটি ব্লকে থ্রিডি সাইসমিক সার্ভে (ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ) পরিচালনার জন্য বাপেক্সকে কার্যাদেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কার্যাদেশ দেয়ার আগে কোম্পানিটি বাপেক্সের খনন কার্যক্রম, সাইসমিক জরিপ, রিগ ও অন্যান্য খনন যন্ত্রপাতির কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য একটি টিম গঠন করে। ওই টিমটি সরেজমিন গিয়ে শাহবাজপুরে বাপেক্সের চলমান থ্রিডি সাইসমিক জরিপ পর্যবেক্ষণ করে এই প্রতিবেদন দেয় বাপেক্সকে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম রুহুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, রিগ ক্রয়, সাইসমিক সার্ভে, খননসহ সব ধরনের কার্যক্রম তার যোগদানের আগে সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই এ প্রসঙ্গে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে বাপেক্সের ভূতাত্ত্বিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাপেক্স এ পর্যন্ত ২৮টির বেশি কূপ খনন করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে ১১০টি কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে রেখেছে। সেক্ষেত্রে ৫টি কূপে গ্যাস না পাওয়ার ঘটনা তেমন গুরুতর নয়। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ৩ অনুপাত ১। বাপেক্স তার চেয়ে ভালো করছে। তার মতে বাপেক্স বিদেশি কোম্পানির চেয়ে অনেক কম দামে কূপ খনন করছে।

বাপেক্স পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বাপেক্স নিয়ে ওই বিদেশি কোম্পানির প্রতিবেদনের কপি মন্ত্রণালয়েও আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাপেক্স হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য টুডি ও থ্রিডি সাইসমিক সার্ভে, জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং অনুসন্ধান কূপ খনন করে থাকে। এ কাজের জন্য বাপেক্সের নিজস্ব জনবল, টেকনিক্যাল সার্ভিস, পরীক্ষাগার এবং ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব কাজের বিপরীতে জনবল নিয়োগ, রিগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং বিদেশি সেবা আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু বিপুল অর্থ খরচ করেও কিছু কিছু টেকনিক্যাল কারণে ইতিবাচক ফল পাচ্ছে না বাপেক্স। এর মধ্যে জরিপ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া এবং রিগ ও খনন যন্ত্রপাতির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় সেগুলো থেকে সুস্পষ্ট তথ্য না পাওয়া অন্যতম কারণ।
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য ত্রিমাত্রিক সাইসমিক জরিপ (থ্রিডি) বিভাগের প্রকল্প পরিচালক মেহেরুল হাসানের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি টেলিফোন ধরেননি। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পরপর দুইদিন তার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। অফিস থেকে বলা হয়েছে তিনি বাইরে আছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাপেক্সের অপরিকল্পিত জরিপ ও কূপ খননে কচ্ছপগতির কারণে দেশে গ্যাস সেক্টরে চলছে নৈরাজ্য। মাটির নিচে পড়ে আছে মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস। সাগর ও স্থল ভাগের বিভিন্ন ব্লকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ভাণ্ডার থাকলেও বাপেক্সের অদক্ষ জনবল ও অস্পষ্ট জরিপের কারণে উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এতে একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে অপরদিকে বাড়ছে গ্যাস বিদ্যুতের দাম। বেশি দামে গ্যাস কিনে শিল্প মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত মিল কারখানা। যেগুলো আছে সেগুলোও রুগ্ন শিল্পে পরিণত হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রামের উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ পেয়েছে। কিন্তু গত ৪ বছরে সেই সমুদ্রসীমায় কোনো জরিপ, অনুসন্ধান ও কূপ খনন শুরু করতে পারেনি সরকার। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার তাদের অংশে গ্যাস অনুসন্ধান, জরিপ ও কূপ খনন শেষে গ্যাস উত্তোলন করেছে।

তেল-গ্যাস সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মিয়ানমার অংশে গ্যাস উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশ অংশে থাকা গ্যাসের প্রবাহ সেদিকে চলে যাচ্ছে। তাদের মতে এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের অর্জিত সমুদ্রসীমার সব গ্যাস সম্পদ এক পর্যায়ে শূন্য হয়ে যাবে। এটি গ্যাস নিয়ে দেশি বিদেশি সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের বিশাল গ্যাস ক্ষেত্র এভাবে শূন্য করে দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া ও দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস করে দেয়ার চক্রান্ত। বাপেক্সকে এই দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের কবল থেকে বের করে আনাতে না পারলে এই প্রতিষ্ঠানটিও বন্ধ হয়ে যাবে।

সাইসমিক সার্ভে : টু ডি সাইসমিক সার্ভে (দ্বিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ) করে মূলত যে কোনো গ্যাস ক্ষেত্রের স্ট্রাকচার চিহ্নিত করে কূপ খননের মাধ্যমে গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করা হয়ে থাকে। আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ড থেকে সঠিকভাবে নির্ধারিত গ্যাসের স্তর ও আকার সূক্ষ্মভাবে নির্ণয়ের জন্য থ্রিডি সাইসমিক সার্ভে করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ডগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে টুডি সাইসমিক সার্ভে করে। বাপেক্স পরবর্তীতে ওই এলাকায় থ্রিডি সাইসমিক সার্ভে করেও অনেক ক্ষেত্রে সঠিক কূপ খননের স্থান নির্ধারণ করতে পারেনি। এ কারণে কৈলাসটিলা ৭ নম্বর কূপ, রশিদপুর ১০ ও ১২ সালদা ৪ ও সালদা (পুনর্বাসন) ১ কূপ খনন করেও গ্যাস পায়নি। রশিদপুর কূপের থ্রিডি সাইসমিক সার্ভের ভিত্তিতে গ্যাস না পাওয়ায় স্লুমবার্গার নামের একটি বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে পরবর্তীতে সিলেট গ্যাস ফিল্ড এলাকায় থ্রিডি সার্ভে করা হয়। ওই বিদেশি কোম্পানিও তাদের পরীক্ষার প্রতিবেদনে বাপেক্সের কূপ খননের কার্যক্রম, সাইসমিক জরিপ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কী কারণে বাপেক্স এসব কূপ খনন করেছে তার যৌক্তিকতা তদন্ত ও বিশ্লেষণ করা দরকার। এছাড়া শাহবাজপুর ও ভোলা এলাকায় থ্রিডি সাইসমিক সার্ভের ফলাফলেও কূপ খননের সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হয়নি।

রেকর্ডিং সিস্টেম/রেকর্ডিং ওয়াগন :বিদেশি কোম্পানির রিপোর্টে বলা হয়েছে শাহবাজপুর ব্লকে বাপেক্স তাদের রেকর্ডিং সিস্টেমে যে সিভি সফটওয়ার ব্যবহার করছে তা মেয়াদোত্তীর্ণ। রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি পুরনো এবং জিও ফোনগুলোও পুরনো। এসব যন্ত্রপাতি ও ফোনগুলো ভালোভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করে এগুলো দিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এতে তথ্য-উপাত্তের ফলাফল সঠিক ও নির্ভুল পাওয়া যায় না। এগুলোর কোনো বিশ্লেষণও করা হয় না। শট (বিস্ফোরণ) রেকর্ড নিয়মমাফিক প্রিন্ট বা রিভিউ করা হয় না।

রেকর্ডিং ওয়ার্কশপ/ ফিল্ড ইকুইপমেন্ট : একই রিপোর্টে বলা হয়, বাপেক্স তাদের ওই কাজে ২০০৮ সালের জিওফোন ব্যবহার করেছে। জিওফোন টেস্ট করার যন্ত্রও ভালোভাবে কাজ করে না। এ কারণে জিওফোন ভালো না খারাপ তা নির্ণয় না করেই ফিল্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু জিওফোন তৈরি করা হয়েছিল স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত। বহু সাইসমিক ক্যাবলের অবস্থাও খারাপ। যারা এসব যন্ত্রপাতি ও ইকুইপমেন্ট মেরামত করে তারাও অনভিজ্ঞ। তারা আধুনিক টেকনিক ব্যবহার না করেই সার্ভে যন্ত্রপাতি মেরামত করছে। তারা প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রম করে না। রেকর্ডিংয়ের স্পেয়ারও পর্যাপ্ত ছিল না।

জানা গেছে এই প্রতিবেদনের পর ওই বিদেশি কোম্পানি তাদের জালালাবাদের থ্রিডি সাইসমিক সার্ভে করার জন্য বাপেক্সকে কার্যাদেশ না দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। সম্প্রতি সুনেত্রা ও মোবারকপুরেও বাপেক্স টুডি সাইসমিক সার্ভে করে দুটিতেই কূপ খননে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগ ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত যানবাহন, খনন কাজ, স্থানীয় ক্রয় ও জনবল দেখিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। থ্রিডি সার্ভের ক্ষেত্রে এই অপচয় কয়েকগুণ বেশি বলেও ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/54968