৩১ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৫৪

দুই বিদ্যুৎ প্রকল্পে অনিয়মের পাহাড়

কম পোল কিনে বেশি দেখানো * বরাদ্দের অতিরিক্ত ও অনুমোদনহীন ব্যয়

দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) অভিযোগগুলো পেয়েছে। এগুলো হল- উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন ছাড়াই কাজের ধরন পরিবর্তন, টার্নকি চুক্তি না হলেও অর্থব্যয়, বরাদ্দের বেশি টাকার চুক্তি, মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করে প্রকল্প শেষ, কম পোল কিনে বেশি ব্যয় দেখানো, বরাদ্দের অতিরিক্ত ও অনুমোদনহীন ব্যয় এবং সরকারি অর্থায়নের বিপরীতে সুদের নামে অর্থব্যয়।
হাতিয়া দ্বীপে বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য হাইব্রিড সিস্টেম স্থাপন এবং রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড অগমেন্টেশন অব ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক অব ডিপিসিডি (সংশোধিত) প্রকল্প দুটির সমাপ্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে আইএমইডি। এ বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হলে তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, হাতিয়ায় বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রর হাইব্রিড সিস্টেম স্থাপন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে। ডিপিডিসির প্রকল্পেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প দুটির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, মোটা দাগে বলতে গেলে আমরা সীমিত জনবল ও গাড়িসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে শতভাগ প্রকল্প মনিটরিং শুরু করেছি। আশা করছি সফল হব। প্রকল্প পরিদর্র্শনের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, ‘ইনস্টলমেন্ট অব এন অফগ্রিড উইন্ড সোলার হাইব্রিড সিস্টেম ইউদ এইচএফও বেজড ইঞ্জিন ড্রাইভেন জেনারেটর ইন হাতিয়া আইল্যান্ড’ শীর্ষক প্রকল্প ২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় প্রকল্পটির ব্যয় ১৩১ কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু মূল প্রকল্পে ৭ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হাইব্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির সংস্থান থাকলেও সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। দরপত্র তথ্যাবলি পরিবর্তন করে দুটি আলাদা লটে ভাগ করে টার্নকি পদ্ধতিতে ২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করা হয়। অনুমোদন ছাড়াই এর পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে পরবর্তীকালে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াই ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে এরই মধ্যে ৯ কোটি ১৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। সেই টাকা খরচেও নানা অনিয়ম হয়েছে। যেমন প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সালটেন্সি সার্ভিস-টার্নকি খাতে তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকার বিপরীতে খরচ হয়েছে তিন কোটি ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। কিন্তু আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের আওতায় কোনো টার্নকি চুক্তি হয়নি, তাই এই টাকা ব্যয় করা যুক্তিযুক্ত নয়। এছাড়া কন্সালটেন্সি সার্ভিস খাতে বরাদ্দ ছিল তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু এ সংশ্লিষ্ট ফার্ম বা ব্যক্তির সঙ্গে আট কোটি ৭৪ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়েছে। যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। সেই সঙ্গে প্রকল্প প্রস্তাবে এ খাতের অনুমোদিত মেয়াদকাল ছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু কন্সালটেন্সি সার্ভিসের সঙ্গে ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট পর্যন্ত মেয়াদ ধরে চুক্তি করা হয়। আইএমইডি বলছে, এটি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। তা ছাড়া মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না হওয়ায় প্রকল্পটির উদ্দেশ্যও পূরণ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পটির সর্বশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক আরইউএম রাশেদুল হাসান মঙ্গলবার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। পরবর্তীকালে আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা বেশ আগের কথা। আমি প্রকল্পের একেবারেই শেষ পর্যায়ে দায়িত্বে ছিলাম। তাই এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। পরে অফিসে এলে বিস্তারিত বলা যেতে পারে।
অন্যদিকে, ‘রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড অগমেন্টেশন অব ডিস্ট্রবিউশন নেটওয়ার্ক অব ডিপিডিসি’ ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেক অনুমোদন লাভ করে। এ সময় ১৬৯ কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরবর্তী সময় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ২০১ কোটি ৩০ লাখ টাকা করা হয় এবং মেয়াদ ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) শেষ পর্যন্ত ১৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টকা ব্যয় করে। গত বছরের ২ ফেব্র“য়ারি সমাপ্ত এ প্রকল্প পরিদর্শন করে আইএমইডি। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী ১১ হাজার ৩০০টি ১৫ মিটার পোল সংগ্রহ করার কথা থাকলেও বাস্তবে ১০ হাজার ৯১৭টি পোল সংগ্রহ করা হয়েছে। পরিমাণে কম হলেও অধিক ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া হার্ডওয়্যার ম্যাটেরিয়ালস ফর ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম খাতে ১১ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও ১৪ কোটি ২৬ লাখ ৭৬ হাজার অর্থাৎ দুই কোটি ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা অধিক ব্যয় করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পটিতে নির্মাণকালীন সুদ বাবদ ১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। এর মধ্যে ছয় কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু আইএমইডি ৬৩ কোটি ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার টাকা সরকারি ঋণের বিপরীতে ছয় কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার টাকা নির্মাণকালীন শুধু কিভাবে ব্যয় হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই টাকা অর্থবিভাগকে পরিশোধ করা হয়েছে কিনা তার স্বপক্ষে প্রমাণাদি দাখিল করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনে ট্রান্সফরমার খাতের ব্যয় একেক স্থানে একেক রকম দেখানো হয়েছে। প্রদর্শিত এ ব্যয়ের অসমাঞ্জস্যতার ব্যাখা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জুলফিকার যুগান্তরকে বলেন, আমি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু ক্রয় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। যারা অর্থ নিয়ে কাজ করেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/54628/