এখনও জমেনি ফুটপাতে ঈদের কেনাকাটা
৩০ মে ২০১৮, বুধবার, ৯:৫২

বিদেশি পোশাকের দাপটে দেশীয় পোশাক কোনঠাসা

আসন্ন ঈদ উল ফিতর সামনে রেখে বিপণি বিতানগুলোতে ক্রেতা সমাগম বাড়ছে। স্তরে স্তরে সাজানো পোশাক কিন্তু এখনও বেচাকেনার ব্যস্ততা নেই। কিন্তু মিরপুর বেনারসী পল্লীর চিত্রটা ভিন্ন। ১২ রোজা পেরিয়ে গেলেও এখানে তেমন ক্রেতা সমাগম নেই। বিদেশী পোশাকের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দেশীয় পোশাক। এবারের ঈদ বাজারেও বিদেশী পোশাকের আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। বিদেশী পোশাকের দাপটে দেশীয় পোশাক অনেকটা কোনঠাসা। তবে দেশী-বিদেশী কোনো পোশাকই তেমন বিক্রি হচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর চাঁদনীচক, গাউছিয়া, নিউ মার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেটে ক্রেতার তেমন সমাগম নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসব মার্কেটে ক্রেতাদের উপস্থিতি কিছুটা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নারীদের পোশাক ও পণ্যের আধিক্যের কারণে নারীরাই মূলত এসব মার্কেটের ক্রেতা।

এসব মাকেটের বিক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য বছরগুলোতে দেখা গেছে দশ রমযানের পরেই পুরোদমে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। অবস্থা এমন যে মনেই হচ্ছে না রমযান শুরু হয়েছে। এবারের ঈদ বাজার নিয়ে আমরা অনেকটা হতাশ।
একই চিত্র দেখা গেছে, ছেলেদের পোশাকের মার্কেটগুলোতে। রাজধানীর নিউমার্কেট-এলিফেন্ট রোড, ঢাকা কলেজের সামনে ছেলেদের পোশাকের দোকানে ক্রেতাদের তেমন ভিড়-উপস্থিতি ছিল না। রুচিসম্পন্ন, পর্যাপ্ত ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি থরে থরে সাজিয়ে রাখলেও ক্রেতা সাধারণের তেমন আগাগোনা নেই দোকানগুলোতে।
নিউ মার্কেটের ছেলেদের পোশাকের এমএম ফ্যাশনের হাউজের দোকানী আওয়াল শেখ বলেন, আমরা সব ধরনের নিউ কালেকশন নিয়ে আসছি। কিন্তু সবে তো আজ বারো রোজা তাই ছেলেরা এখনও ঈদের কেনাকাটা শুরু করেনি। যেহেতু কিছুদিনের মধ্যেই দর্জিপাড়ায় পোশাক তৈরির অর্ডার নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সে কারণে নারীদের ঈদ কেনাকাটা কিছুটা জমজমাট হয়ে উঠেছে।
মার্কেটটির পাশের দোকান ওয়ান ক্লাবের বিক্রয় কর্মী নাজিম উদ্দিন বলেন, ছেলেদের পোশাকের ওেক্ষত্রে বর্তমানে অল্প কিছু ক্রেতা পাচ্ছি, আশা করি ১৫ রমজানের পর ছেলেদের ঈদ কেনাকাটা জমজমাট হয়ে উঠবে।

এদিকে নিউমার্কেটে ছেলেদের সানগ্লাস, বেল্ট, জুতা, স্যান্ডেলের দোকানগুলোতেও তেমন একটা ক্রেতা উপস্থিতি দেখা যায়নি। নিউ মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় প্যান্টের দোকানগুলো ঘুরে জিন্স প্যান্ট দেখছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময় আহমেদ এবং আশিকুর রহমান। তন্ময় আহমেদ বলেন, আজ ঘুরে ঘুরে কি কালেকশন আছে তা দেখতে এসেছি। ঈদের মূল কেনাকাটা শুরু করবো ঈদের ৭/৮ দিন আগে। ঈদে ছেলেদের কেনাকাটা জমে উঠে মূলত ১৫/২০ রমজানের পর থেকে। তাই এখন তেমন ক্রেতাদের উপস্থিতি নেই।
কারণ হিসেবে ভারতীয় ভিসা সহজ করা, বেনারসী পল্লীর সামনের রাস্তা খোঁড়া এবং মেট্রোরেলের জন্য সৃষ্টি হওয়া যানজটকে দায়ী করেছেন বিক্রেতারা।
ঐতিহ্যবাহী শাড়ী বেনারসীর জন্য বিখ্যাত মিরপুরের বেনারসী পল্লী। সবসময়ই বিভিন্ন বয়সী নারীর পছন্দ এখানকার শাড়ী। ঈদ, বিয়ে, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে দেড়শ’র বেশি দোকানের এ জামদানি পল্লী থাকে অনেকের আগ্রহের শীর্ষে। কিন্তু এবার এখানে ঈদের বাজার তেমন জমে ওঠেনি।
ঈদের বাজারে এখানে বেনারসী, কাতান, কাঞ্জি বরম, গাদোয়াল, চেন্নাই কাতানসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন শাড়ির পাশাপাশি আছে লেহেঙ্গাও। তবে দাম বাড়তি বলে অভিযোগ কিছু ক্রেতার। এক সময় দূরদূরান্ত থেকে এখানে ক্রেতারা আসতেন। ঐতিহ্যবাহী শাড়ির টানে এখনো আসেন অনেকে।
তবে বিভিন্ন কারণে এ পল্লীতে ক্রেতা কম থাকলেও এখনো আশা ছাড়েননি ব্যবসায়ীরা। আগামী মাসের শুরুর দিকে বিক্রি বাড়বে বলে আশা তাদের।

জানা গেছে প্রতি বছরের মত এবারও সারা দেশে বিদেশী পোশাকের আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। সুলতান সোলাইমান, পরিমনি, রাখি-বন্ধন, খোকা বাবু, তরী প্রভূতি নামের পোশাকের দৌরাত্ম দেখা যাচ্ছে। এসব পোশাকের ভিড়ে দেশীয় পোশাক বাজারে খোজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশিয় পোশাক বাজারে রয়েছে, তাও আবার বিদেশী পোশাকের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
অবস্থা এমন দাড়িয়েছে দেশী পোশাক খোজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিদেশী নাম ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য এবার বিদেশী নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে ক্ষতি হচ্ছে দেশের। এক দিকে আমাদের ঈদ বাজারে বিদেশী পোশাকে বাজার তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেতার কাছ থেকে বিদেশে নাম করে বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। অথচ এসব দেখার কেউ নেই।

রাজধানীর ঢাকার সপিংমলগুলোতে ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়। বিক্রেতারা বলেন, দেশের সীমান্তপথে অবৈধভাবে আসা ভারতীয় শাড়ি-কাপড়ে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার ঈদের বাজার। সারাদেশে মাদক বিরোধী অভিযানের সুযোগে এবার ভারতীয় শাড়ি দেশে বেশি ঢুকেছে।
স্বনামধন্য বিপণি বিতানের প্রতিটি দোকানে এখন শোভা পাচ্ছে দৃষ্টি কাড়া ভারতীয় শাড়ি-কাপড়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বিপণি বিতানগুলো ইতোমধ্যে ঈদের কাপড়ের সাজ-সজ্জায় রঙিন হয়ে উঠেছে। এসব বিপণি বিতানের প্রতিটি দোকানে দেশীয় কাপড়ের পাশাপাশি ভারতীয়, পাকিস্তানী ও চায়না কাপড় শোভা পাচ্ছে। বিশেষ করে কাপড়ের পাইকারী বাজার খ্যাত সদরঘাট, গুলিস্থান, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, বসুন্ধরা, ইস্টানপ্লাজা, চন্দ্রিমা মার্কেটসহ সবকটি বিপণি বিতান সয়লাব হয়ে গেছে ভারতীয় শাড়ি ও কাপড়ে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভারতীয় শাড়ি কাপড়ের মধ্যে থ্রীপিচ, শটপিচ, লেহেঙ্গা, কামিছ, শাড়িসহ নানারকম কাপড় রয়েছে। যেগুলো রংয়ে চকচক করলেও মানে তেমন ভাল নয়। আর এসব কাপড়কে ভারতীয় কাপড় না বলে বিক্রেতারা দেশীয় কাপড় অথবা শুধুমাত্র বিদেশী কাপড় বলে বিক্রি করছে। ফলে দেশীয় শাড়ি কাপড়ের মান সম্পর্কে ক্রেতাদের মধ্যে খারাপ ধারণা জন্মাচ্ছে। দেশীয় কাপড়ের ঐতিহ্য নিয়ে দেশীদশ, অঞ্জনস, আড়ংসহ নগরীর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতারা জানান, বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে নিম্মমানের ভারতীয় শাড়ি-কাপড়কে দেশী কাপড় আর আমাদের শপিং সেন্টারে এসে দেশী কাপড়কে ভারতীয় বা বিদেশী কাপড় বলে ক্রেতারা। এ নিয়ে তাদের বিপাকে পড়তে হয়।

বিক্রেতারা জানান, এ পর্যন্ত ভারতীয় বিভিন্ন কাতান শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। বিক্রির তালিকায় এগিয়ে আছে আদি জামদানি। ভরা বর্ষায় ঈদ উদযাপনে গরম ও বৃষ্টির কথা মাথায় রেশে দেশীয় বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস এনেছে হালকা ও আরামদায়ক শাড়ি। আধুনিকতার সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উৎসব পালনে তরুণীরা বেছে নিচ্ছেন জর্জেট, শিফন ও সিল্কের কাপড়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাবরের মতো কাঞ্জিভরম, পঞ্চমকলি, অপেরা কাতান, কাঁঠাল কাতান, আলাপ কাতান, ভোমকা কাতান, খাদি কাতান, শিফন, ক্রাফট, জর্জেটসহ বিভিন্ন নামের ভারতীয় শাড়ির দখলে এ দেশের বাজার। শাড়ি আমদানিকারকরা জানালেন, এবার ঈদ বাজারকে লক্ষ্য রেখে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার শাড়ি আমদানি হয়েছে। বিক্রেতাদের মতে, ভারতীয় শাড়ির প্রতি এ দেশের ক্রেতাদের দুর্বলতা থাকলেও আগে এর বাজার ছিল সীমিত। কিন্তু গত এক দশকে বাংলাদেশে ভারতীয় শাড়ির বাজার বড় হয়েছে কয়েকগুণ, একই সঙ্গে ভারতীয় শাড়ির চাহিদা তৈরি হয়েছে সব শ্রেণি ক্রেতার মাঝেই।
বিভিন্ন শাড়ির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শাড়িগুলোতে এমব্রয়ডারি ও ডলার ব্যবহার করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে শাড়িতে ব্লক ও কারচুপির কাজ বেশি দেখা গিয়েছিলে। এবারের ঈদ বাজারে ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে সুতি ও সিল্ক শাড়ি। আর জামদানির দাম পড়বে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এবারের ঈদ উপলক্ষে মসলিন শাড়িতে করা হয়েছে বির্টস, দপকা, জরি কম্বিনেশনে হাতের কাজ। জামদানি শাড়িতে করা হয়েছে পাল্স, বিটস দিয়ে হাতের কাজ। এছাড়া আছে শিপন ও জর্জেট শাড়ি। গরমের কারণে শাড়ির রং হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে হালকা রং। গরমের কারণে শাড়ির রং হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে হালকা কালার। গোলাপি, বেগুনি, হালকা নীল, জলপাই, এ্যাশ, অফহোয়াইট কালার ব্যবহার করা হয়েছে শাড়িতে। মসলিন শাড়ির দাম পড়বে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা, জামদানি, জর্জেট ও শিপন শাড়ির দাম পড়বে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। সুতি, সিল্ক, হাফসিল্ক ও মসলিন শাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে ঈদ উৎসবের রং। ডিজাইনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এ্যাপ্লিক, সুতার কাজ, কারচুপি, ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিনপ্রিন্টসহ নানা মাধ্যম। তবে এবারের শাড়ির বাজারে দামটা বেশ চড়াও বলেছেন এমন অনেক ক্রেতা। আর তা স্বীকার করলেন অনেক বিক্রেতাই।
দর্জিবাড়ি প্রধান ফ্যাশন ডিজাইনার বলেন, ঈদে নারীর পছন্দের ভূষণ বরাবরের মতোই শাড়ি। হালকা এই পোশাকটি যেমন পরতে আরাম, তেমনি দেখতেও ভালো এবং স্নিগ্ধ লাবণ্যময়। আর ঈদের সময়টায় আটপৌরে শাড়িতে স্টাইলিং করতে পারলেই কিস্তিমাত।
তিনি বলেন আমাদের ঈদ বাজার ভারত আর চায়নার দখলে রয়েছে। এই পোশাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশীয় কাপড়ের ব্রান্ড গড়ে উঠেছে। এতে করে বেশ কিছু গ্রাহকও তৈরি হয়েছে। আগামীতে এ অবস্থা ধরে রাখতে পারলে বাজারে বিদেশী পোশাকের আধিপত্য কমবে।

http://www.dailysangram.com/post/332345