২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৫

পরিকল্পনায় গণপরিবহন বাস্তবায়নে ফ্লাইওভার

রাজধানীর যানজট নিরসন এবং গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেওয়া পরিকল্পনায় গুরুত্ব পায় গণপরিবহন; কিন্তু বাস্তবায়নে গুরুত্ব পায় ফ্লাইওভার। ২০০৪ সালে প্রণীত 'কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি)' তিনটি মেট্রোরেল ও বাসের জন্য তিনটি পৃথক লেন (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ ছিল। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। পরিকল্পনায় না থাকলেও ১৪ বছরে রাজধানীতে নির্মিত হয়েছে পাঁচটি ফ্লাইওভার। বিআরটি নির্মাণের পথেও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। আরও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনাও চলছে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে এসটিপি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০ বছর মেয়াদি এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে ভেস্তে গেছে। এসটিপি সংশোধন করে ২০১৬ সালে প্রণীত হয় সংশোধিত এসটিপি (আরএসটিপি)। যানজট নিরসনে আরএসটিপিতে পাঁচটি মেট্রোরেল, দুটি বিআরটি, রাজধানীকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার পথ ও মহাসড়কগুলোকে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করতে ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এসটিপির মতো আরএসটিপিতেও যানজট নিরসনে গণপরিবহনবান্ধব প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে একটি মেট্রোরেলের কাজ দ্রুত এগোলেও গণপরিবহনবান্ধব অন্য প্রকল্প চলছে ধীরগতিতে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা রাজধানীর যানজটের জন্য মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেটকারকে দায়ী করেন। মাত্র আট হাজার বাসের বিপরীতে আড়াই লাখ প্রাইভেটকারের দখলে ঢাকার রাজপথ। ফ্লাইওভারের কারণে প্রাইভেটকার দিন দিন আরও বাড়ছে- এমন অভিমত পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হকের। তিনি সমকালকে বলেন, প্রাইভেটকার ফ্লাইওভারের সুফলভোগী। ফ্লাইওভার যত বাড়বে, প্রাইভেটকার তত বাড়বে।

২০০৪ সালের পরিকল্পনায় বাসের জন্য পৃথক লেন (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ থাকলেও ১৪ বছরেও এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। আরএসটিপিতেও দুটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটির একাংশের নির্মাণকাজ চলছে। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার বিআরটি-৩-এর নির্মাণের উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের জুনে। প্রকল্পের অর্থায়ন জোগাড় না হওয়ায় প্রথম ধাপে জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ২১ কিলোমিটারের অর্থায়ন এখনও নিশ্চিত হয়নি।

জয়দেবপুর-বিমানবন্দর অংশের মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ এখনও শুরু হয়নি। চলছে বিআরটির অ্যালাইনমেন্টের উন্নয়নের কাজ। ড্রেন ও ডিপো নির্মাণকাজ চলছে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী যানজটমুক্ত বাস চলাচলের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি বিআরটি। বিদ্যমান সড়কেই তা নির্মাণ সম্ভব। এ পদ্ধতিতে সড়কের মাঝবরাবর বাসের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা হয়। বাস লেনে অন্য কোনো যানবাহনের প্রবেশ ও চলাচলের সুযোগ নেই। রাস্তার ইন্টারসেকশনে (মোড়) ওভারপাস নির্মাণ করা হয়, যাতে সিগন্যাল এড়িয়ে বাস চলতে পারে। পথের মাঝেই থাকে যাত্রী ওঠানামার বাসস্টপেজ। বিআরটির নির্মাণকাজ ফ্লাইওভারের মতো ব্যয়বহুল নয়। দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, তাই নির্মাণকালীন দুর্ভোগও কম।

নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৬৯১ কোটি টাকা। সদ্য-সমাপ্ত মগবাজার ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটার বিআরটির বাস্তবায়ন ব্যয় শতকোটি টাকার কম। ব্যয় সাশ্রয়ী ও যানজটমুক্ত চলাচলের নিশ্চয়তার পরও বিআরটি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনীহা রয়েছে বলে মনে করেন ড. শামছুল হক।

তিনি সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, উন্নয়ন মানে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ। তাই ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বহুতল কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণ করা হয় উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে। অথচ এগুলো যানজট দূর করতে পারে না। শহরের মধ্যে ফ্লাইওভার যানজট আরও বাড়ায়। বিআরটি কার্যকর হলেও ছোট স্থাপনা এবং ব্যয় কম বলে হয়তো এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্নিষ্টদের আগ্রহ নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মহাপরিকল্পনায় না থাকলেও মগবাজার ও গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় গৃহীত আরসিটিপিতে যেসব প্রকল্প নেই, তা বাস্তবায়ন না করার ঘোষণা রয়েছে। মহাপরিকল্পনাবহির্ভূত প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা মেট্রোরেল বিআরটির মতো গণপরিবহনবান্ধব প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) রাজধানীর শান্তিনগর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত নতুন একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করবে। বিআরটি-৩ ও এমআরটি-১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থারও এতে আপত্তি ছিল। কিন্তু সেগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় প্রকল্প গ্রহণে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংস্থাটি আরএসটিপির বাস্তবায়নকারী। মহাপরিকল্পনায় না থাকলেও ফ্লাইওভার নির্মাণে অনুমোদন দেওয়ার প্রসঙ্গে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহমেদ দাবি করেছেন, বিআরটির সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক হবে না। তিনি বলেন, বাবুবাজারে ১০ লেনের 'স্টেইড কেবল ব্রিজে'র হবে। বাকি অংশে বিআরটির সঙ্গে ফ্লাইওভারের অ্যালাইনমেন্টে সমন্বয় করা হবে।

গাজীপুর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত মেট্রোরেল (এমআরটি-১) নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে আরএসটিপিতে। এমআরটি-১ মাটির নিচেই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ফ্লাইওভারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না বলে দাবি করছে ডিটিসিএ। কিন্তু মেট্রোরেল মাটির ওপর (এলিভেটেড) হলে কী হবে, তার জবাব তাদের কাছে নেই।

শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভার বিআরটি-৩-এর বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল অংশের সঙ্গে কয়েকটি জায়গায় সাংঘর্ষিক। পল্টন মোড় দিয়ে মেট্রোরেল যাবে। তার ওপর দিয়ে এ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এ মোড়ে বিআরটি লেন কোথায় হবে, তারও উত্তর নেই। গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাবে রাজউকের প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার।

এসব বক্তব্যকে যৌক্তিক মনে করছেন না ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, মগবাজার ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি অংশের কারণে এরই মধ্যে বিআরটি বাধায় পড়েছে। ফ্লাইওভারের ওপরে বিআরটির লেন করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আবার ফ্লাইওভারের নিচেও জায়গা নেই। একই অবস্থা হবে রাজউক ফ্লাইওভার নির্মাণ করলে। তিনি বলেন, আরএসটিপিতে স্পষ্ট করে বলা আছে, যানজট নিরসনে কী কী করতে হবে। সেখানে ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা নেই।

অর্থাভাবে আটকে থাকা বিমানবন্দর-ঝিলমিল অংশের বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তখন বলা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এরপর আলোচনা আর এগোয়নি। সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, কবে নাগাদ বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়া যাবে।

 

http://samakal.com/capital/article/18051705