চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে গতকাল রাজধানীর ধলপুরের সিটি পল্লী বস্তি থেকে আটককৃতরা।
২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৪

মাইকিং করে সাঁড়াশি তল্লাশি উধাও মাদক কারবারিরা

রাজধানীতে দুই অভিযানে আটক আরো ৭৫

সোমবার সকাল ১১টা। যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের আউটফল সিটি পল্লী বস্তির কাছে বারবার মাইকে ঘোষণা আসে, ‘আজ এখানে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হবে। যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকেন। অযথা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। করলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আকস্মিক এই ঘোষণায় এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বস্তির লোকজন যার যার ঘরে বা দোকানে ঢুকে পড়ে। এরপর কয়েক শ পুলিশ নামে অভিযানে। দুপুর দেড়টায়
অভিযান শেষ হলে দেখা যায়, তিন নারীসহ ৫৬ জনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল দুপুরেই একইভাবে রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী থানার ঝিলপাড় এলাকায়ও অভিযান চালিয়ে আরো ১৯ জনকে আটক করে পুলিশের পৃথক দল।

আউটফল সিটি পল্লী বস্তিতে অভিযানের সময় এই প্রতিবেদক অনেকের সাঙ্গে কথা বলেন। তারা বলছিল, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই মাদক সেবনকারী। বাকিরা খেটে খাওয়া শ্রমিক। আটককৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। বড় মাদক কারবারিরা অভিযানের আগেই পালিয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘শীর্ষরা পালিয়েছে। তবে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই থানার তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি।’

অভিযানের সময় কথা হয় আনিস নামে সাত বছর বয়সী এক শিশুর সঙ্গে। সে কাঁদছিল। কাছে গিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই প্রথমে চুপ হয়ে যায় শিশুটি। পরে বলে, ‘আমি খোকনের পোলা। আমার বাবারে পুলিশ ধইরা নিয়া গ্যাছে। আমার বাবা রিকশা চালায়। পুলিশ আমার বাবারে ছাইড়া না দিলে আমার বোন ও আমি কষ্ট পামু।’ এই শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় বস্তির আরো অনেকে জড়ো হয়ে হয়রানির অভিযোগ করে। জিলানী, নাজু, রেখাসহ আরো কয়েকজন বড় মাদক কারবারি বস্তিতে থাকে উল্লেখ করে তারা বলে, বড়দের না ধরে পুলিশ চুনোপুঁটিদের ধরেছে। একজন কালের কণ্ঠকে বলছিল, কয়েক দিন ধরে বস্তিতে মাদক বেচাকেনা কম। এই সময় একজন নারী এগিয়ে এসে জোরে জোরে বলতে থাকেন, ‘হইব কেমনে? বস্তির লগেই তো র্যা ব অফিস।’ তাঁর কথায় আরো অনেকে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ধলপুরের এই বস্তির পাশেই র্যা ব-১০-এর কার্যালয়। সিটি পল্লী বস্তির ভেতরে নব বস্তি, আয়নালের বস্তি ও পোড়া বস্তি নামে আরো তিনটি বস্তি রয়েছে। এই চারটি বস্তি থেকেই মাদক সেবক ও মাদক কারবারি সন্দেহে ৫৬ জনকে আটক করে পুলিশ। অভিযানে ছয় হাজার ইয়াবা, ১০ কেজি গাঁজাসহ ফেনসিডিল ও হেরোইন উদ্ধার করা হয় বলে জানায় পুলিশ। দেখা যায়, আটককৃতদের মধ্যে বেশির ভাগ উঠতি বয়সী তরুণ। কিছু যুবকও রয়েছে। তাদের রাস্তায় পুলিশি নজরদারির মধ্যে কিছু সময় বসিয়ে রাখার পর গাড়িতে উঠিয়ে থানায় নেওয়া হয়। বিভিন্ন থানার পুলিশ সদস্যরা ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশ এ অভিযানে অংশ নেয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বস্তিতে মূলত সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও কর্মচারীরা থাকেন।

অভিযানের পর ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপস) মো. মনির হোসেন বলেন, মাদক কারবারিদের ছাড় নেই। যারাই মাদক সেবন ও মাদক কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হবে। যদের আটক করা হয়েছে তারা সবাই মাদক কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ নিরপরাধ থাকলে ছেড়ে দেওয়া হবে।
এ ছাড়া গতকাল দুপুরে শাহ আলীর ঝিলপাড় এলাকা থেকে ১৯ জনকে আটক ও চার কেজি গাঁজাসহ, ইয়াবা ও হেরোইন উদ্ধার করা হয়। অভিযান শেষে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

আতঙ্ক ও গণসচেতনতা দুটিই সৃষ্টি করতে ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্জ। গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, জনগণ দেখছে, আমরা মাদক স্পটগুলোয় অভিযান চালাচ্ছি। মাদক উদ্ধার করছি, মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করছি। এতে গণসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের আতঙ্কিত করাও উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, শীর্ষস্থানীয় মাদক কারবারিদের ১১ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। এই অভিযানের আগে ও পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। জানুয়ারি থেকে রবিবার (২৭ মে) পর্যন্ত রাজধানীতে পাঁচ হাজার ৩০০ মাদকের মামলা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

গত রবিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, হাজারীবাগ, গণকটুলী, কারওয়ান বাজার, কমলাপুর টিটিপাড়া বস্তি ও বনানীর সাততলা বস্তি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের পাশাপাশি র্যা ব, র্যা ব ও পুলিশের গোয়েন্দা, স্পেশাল আর্মড ফোর্স ও ডগ স্কোয়াডের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তবে বড় মাদক কারবারিরা ধরা পড়ছে না। গত ২৪ মে মাদকবিরোধী কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/05/29/641636