২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪৮

দুর্ভোগের ২৬শ’ কিলোমিটার

গাড়ি চলে থেমে থেমে * গন্তব্য পৌঁছতে অতিরিক্ত সময় লাগছে ৩-৬ ঘণ্টা * ঈদে পরিস্থিতি শোচনীয় হওয়ার শঙ্কা * বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত সওজের মেরামত কাজ

সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কের অন্তত ২ হাজার ৬১৬ কিলোমিটার সড়কে রয়েছে ভাঙাচোরা। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪৩ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। বাকি এক হাজার ৭৩ কিমি. সড়কের অবস্থাও নাজুক। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ জরিপে এসব সড়ককে ‘ভেরি ব্যাড’ ও ‘ব্যাড’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খারাপ সড়কের দৈর্ঘ্য এর চেয়ে অনেক বেশি। গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক উন্নয়ন কাজ চলছে। অনেক স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ হাটবাজার ও পার্কিং।

এসব কারণে সড়ক ও মহাসড়কে থেমে থেমে চলছে গাড়ি। প্রায়শ ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। আবার অবকাঠামোগত সংকট ও পর্যাপ্ত ফেরির অভাবে ফেরিঘাটেও দক্ষিণাঞ্চলগামী গাড়ির লম্বা সিরিয়াল দিতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে দূরপাল্লার গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে। কোনো কোনো রুটে লাগছে আরও বেশি সময় । এতে একদিকে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন, অপরদিকে লোকসানের শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
পরিবহন ব্যবসায়ীদের মতে, গত সপ্তাহে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও বাকি রুটগুলোর সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান উন্নতি নেই। ঈদে এসব সড়কের ওপর গাড়ির চাপ আরও বাড়বে। এভাবে চলতে থাকলে ঈদে পরিস্থিতি শোচনীয় আকার ধারণ করবে।
তবে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মতে, একটানা কয়েকদিন রোদ না হলে ঈদের আগে সড়ক মেরামত করা সম্ভব হবে না। ইটসুরকির জোড়াতালির রাস্তায় চলতে হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

এসব বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গত বছর নির্ধারিত সময়ের পরে বৃষ্টিপাত শেষ হয়েছে। এ বছর আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ৩৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
এ কারণে রাস্তা মেরামতে একটু সমস্যা হচ্ছে। সাময়িক বিড়ম্বনা হচ্ছে। কয়েকদিন রোদ পেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, যানজটের জন্য শুধু রাস্তাকে দায়ী করা যাবে না। অনেক রাস্তা অবৈধ দখল হয়ে আছে, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।
সড়কে ভোগান্তির কথা জানিয়ে বাস মালিকদের সংগঠন ঢাকা বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. আবদুল মালেক যুগান্তরকে বলেন, রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। চলার মতো অবস্থা নেই। থেমে থেমে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকেও থাকতে হচ্ছে।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ১০-১২ কিলোমিটার রাস্তা মেরামত ও অবৈধ দখলদারদের দখলে। ওই পথ পাড়ি দিতেই দুই-তিন ঘণ্টা লাগছে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ ও সিলেটগামী রাস্তার অবস্থাও নাজুক। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সড়ক মেরামতের নামে ইট-বালু ফেলে রাখছে। একটু বৃষ্টিতে তা উঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ঈদে নাগরিক ভোগান্তি কমাতে সড়কের নাজুক অবস্থার উন্নতির জন্য ৮ জুনের মধ্যে রাস্তা মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পাশাপাশি তিনি নিজেও বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মেরামত কাজ পরিদর্শন করছেন।

স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা সুরাহার চেষ্টা করছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট নিরসনে গত সোমবার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় সংশ্লিষ্ট ডিসি, এসপি ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শুক্রবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যানজট নিরসনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় একই ধরনের বৈঠক করেন। শনিবার নবীনগর ও আশপাশ এলাকার সড়ক পরিদর্শন করেন। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ঈদে যাত্রী পারাপারে নির্বিঘ্ন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। তবে বৃষ্টির কারণে মেরামত কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সড়কের সমস্যায় বাসের প্রতিটি ট্রিপ কয়েক ঘণ্টা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ৬-৭ ঘণ্টার স্থানে লাগছে ৯-১২ ঘণ্টা। কয়েকদিন আগেও এ পথ পাড়ি দিতে লেগেছে ১৮-২২ ঘণ্টা। গত দু’ তিন দিনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের পথ ঢাকা-বগুড়া পৌঁছতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার স্থলে ৮-১০ ঘণ্টা। এর প্রভাব পড়ছে উত্তরবঙ্গের অন্য জেলায় যাতায়াতকারী বাসগুলোর ওপর।
আর ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল যেতে ৬-৭ ঘণ্টার পথ যেতে লাগছে ৮-১০ ঘণ্টা লাগছে। একইভাবে সিলেট যেতে ৬ ঘণ্টার স্থলে ১০ ঘণ্টা। ঢাকা-জামালপুর যেতে লাগছে ৭-৮ ঘণ্টা। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কের ভোগান্তির কারণে যাত্রীরা বিকল্প হিসেবে লঞ্চ, ট্রেন ও বিমান বেছে নিচ্ছে। গত দু’ তিনদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রীর অভাবে অনেক গাড়ি ছাড়তে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, পার্বত্য তিন জেলাসহ কয়েকটি জেলার মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু থেকেই এ মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচপুর ব্রিজে প্রায়ই যানজট তৈরি হচ্ছে। কাঁচপুর ব্রিজ থেকে দাউদকান্দি টোল প্লাজা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হাটবাজার। এছাড়াও রয়েছে ট্র্যাক ও টেম্পো স্ট্যান্ড।
এছাড়া চারলেনের গাড়ি গিয়ে মেঘনা-গোমতি ব্রিজে একলেনে উঠতেই তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। এছাড়া কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান ও ফেনীর ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ স্থলেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, এ রুটের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যাত্রীদের মধ্যে ভোগান্তি আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাসের টিকিট বুকিং নেই। ব্যবসায়িক জীবনে এমন চিত্র দেখিনি। তিনি বলেন, পুরো পথেই গাড়ি চলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে।
জানা গেছে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর গাড়ি চলাচল করে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে। এসব জেলার সড়কগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে যেসব গাড়ি উত্তরবঙ্গে চলাচল করে সেগুলো প্রথমেই বাইপাইল, কালিয়াকৈর, চান্দুরা, টাঙ্গাইল, মির্জাপুরসহ কয়েকটি স্থানে যানজটে আটকা পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশ অনেক দিন ধরেই বাইপাইলে সড়কের অবস্থা খারাপ ছিল। ওই রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে।
এতে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। এছাড়া চারলেনের কাজ চলায় টাঙ্গাইলসহ আশপাশ সড়কে দুই সারিতে গাড়ি চলাচল করছে। এতে সেখানে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আর ঢাকা-ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনাসহ আশপাশের জেলাগুলোর বাস টঙ্গী থেকেই দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ছে। এসব গাড়িও থেমে থেমে চলছে।

আর টঙ্গী থেকে নরসিংদী পর্যন্ত দুই লেনে গাড়ি চলাচল করছে। এ রাস্তার বিভিন্ন অংশ জুড়েই রয়েছে খানাখন্দ। গাড়ি চালকদের মধ্যে দুর্ঘটনা আতঙ্ক বিরাজ করে। অপরদিকে সিলেটের আরেক বিকল্প পথ ভুলতার সড়কের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে রাজধানীর ৩০০ ফুট হয়ে সিলেটের গাড়ি চলাচল করছে বলে জানান পরিবহন ব্যবসায়ীরা।
জামালপুরের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফাতেমাতুজ্জোহরা বলেন, ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা যেতেই চার ঘণ্টা লাগে। ময়মনসিংহ থেকে জামালপুরের সড়ক এতই খারাপ যে গাড়ি হেলেদুলে চলে। আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি কখন গাড়ি উল্টে পড়ে যায়। তিনি বলেন, রাস্তার এই খারাপ অবস্থার কারণে মানুষ গাড়িতে চলাচল করতে চায় না।

বাস মালিক সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, যানজটে সময় বেশি লাগায় উত্তরবঙ্গের গাড়ি ঢাকায় আসতে চায় না। আবার ঢাকার গাড়ি উত্তরবঙ্গে যেতে চায় না। আমরা চালকদের বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে ওইসব জেলায় পাঠাচ্ছি। আমরাও দুর্ঘটনা আতঙ্কে আছি।
আর দক্ষিণবঙ্গের যাতায়াতের সমস্যা উঠে এসেছে নৌ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়। এ সভায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ফেরিতে গাড়ি পারাপারের সমস্যা উঠে আসে। ওই সভায় রাজবাড়ীর ডিসি বলেন, দৌলতদিয়ায় ৬টি ফেরিঘাটের মধ্যে চারটি ঘাট চালু আছে। বাকি দুটি চালুর প্রয়োজন। ঘাটগুলোর অ্যাপ্রোচ সড়ক মেরামত করা দরকার। ওই রুটে ফেরি সংকট আছে বলেও জানান তিনি।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, এইচডিএম রিপোর্টে রাস্তার যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তব অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এ সার্ভে করা হয়েছে। সার্ভের পরই বৃষ্টি মৌসুম শুরু হয়েছে। বৃষ্টির কারণে একদিকে রাস্তা মেরামত সম্ভব হয়নি, অপরদিকে রাস্তায় ভাঙাচোরার পরিমাণ বেড়েছে। বৃষ্টি বন্ধ না হলে রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/53839