২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪৪

বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি

যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অস্বাভাবিকভাবে পণ্য আমদানির জন্য আমদানি ঋণপত্র স্থাপন (এলসি খোলা) হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু চাহিদার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়েনি। ফলে রেকর্ড পরিমাণ পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন বাড়ায় ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা সহনীয় থাকলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে। সব মিলে সামনে দেশের অর্থনীতি এক বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় এমনই আভাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা। এ সঙ্কট মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওই বৈঠকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

রেকর্ড পরিমাণ পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি : আস্বাভাবিকভাবে আমদানি দায় বেড়ে যাওয়ায় এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ৩২০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭০৩ কোটি ডলার। এ অস্বাভাবিক হারে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি হওয়ার পেছনে অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২৫ শতাংশ আমদানি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেবা বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ভারতের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স যায় বাংলাদেশ থেকে। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিক বেড়ে গেছে। তাদের বেতনভাতার পেছনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেবা খাতের ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সেবা বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে ছিল ২৪৬ কোটি ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ৩৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৩৪ কোটি ডলার। সামনে এ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।

চলতি হিসাবের ভারসাম্য রেকর্ড ঋণাত্মক : এক দিকে বাণিজ্য ও সেবা খাতের অস্বাভাবিক ঘাটতি, পাশাপাশি কাক্সিক্ষত হারে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্য রেকর্ড ঋণাত্মক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ৯ মাসে চলতি হিসাবের ভারমাস্য ১৩৭ কোটি ডলার ঋণাত্মক ছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৭০৮ কোটি ডলার হয়েছে, যা এ যাবৎ কালে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র। এর জেরে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-মার্চ) থেকেই সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হতে শুরু করেছে। এটা এখন আরো বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৪১ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা না গেলে সামনে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য আরো ঋণাত্মক হয়ে যাবে।

অর্থনীতিতে বহিঃখাতের চাপ বাড়ছে : এক দিকে চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না; এতে বৈদেশিক মুদ্রার দাম বিশেষ করে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেল ৪৩ ডলার থেকে বেড়ে এখন ৭০ ডলারে উঠে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চাহিদা অনুযায়ী ডলারের সরবরাহ বাড়ছে না, অপর দিকে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ার কারণে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা সহনীয় রাখা গেলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

টাকার মান কমছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানির পরিমাণ ২৫ শতাংশ বাড়লেও রফতানির পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর ৯ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এর সরসাসরি প্রভাব পড়েছে টাকার সাথে ডলারের বিনিময় মূল্যের ওপর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংকগুলো না বুঝে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে দেদার; কিন্তু সেই হারে সরবরাহ না বাড়ায় এলসির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। এর পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর সঙ্কট এখন এতটাই বেড়ে গেছে, অনেক ব্যাংক এখন আর নতুন করে এলসি খুলতে পারছে না। এ দিকে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসির দায়ও বেড়ে গেছে। ফলে অনেক ব্যাংকের ডলারের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। অর্থবছরের শুরুতে যেখানে প্রতি ডলার পেতে ৭৯ টাকা ব্যয় করতে হতো, মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানে এখন তা সাড়ে ৮৪ টাকায় উঠে গেছে। প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতে না পারায় অনেক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারের বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে গতকাল পর্যন্ত ২২১ ডলার বিক্রি করেছে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে। যদিও প্রতিদিনের ব্যাংকগুলোর চাহিদার ১ দশমাংশ পূরণ করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সামনে ডলারের চাহিদা আরো বেড়ে যাবে; কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহরে তেমন উন্নতি হচ্ছে না। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো পড়ে যেতে পারে। এতে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে।

মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে : নির্বাচনী বছর হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে; কিন্তু এটাকে সামাল দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখার প্রায় সব দরজাই বন্ধ হয়ে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। কারণ বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাজারে অতিরিক্ত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার সরবরাহ বেড়ে গেছে। একই সাথে সঙ্কট মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে বিল বন্ডের বিপরীতে টাকা ধার দেয়া হয়, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় রেপো বলে। ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপে সেই রেপোর হারও পৌনে এক শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ নির্বাচনী বছরে রেপোর হার বাড়ানোর কথা ছিল। এ দিকে ব্যাংকগুলোতে টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দিয়েছে। এক দিকে ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, অপর দিকে নানাভাবে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার প্রায় সব দরজাই বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির কার্যকারিতাও অনেকটা থেমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষকদের সতর্ক বাণী : গত সপ্তাহের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, চতুর্মুখী চাপ থেকে দেশের অর্থনীতিকে নিরাপদে রাখতে নীতিনির্ধারকদের সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের সঙ্কট এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/320965