২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪০

মাদক নিয়ন্ত্রণে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ থেরাপি!

পার্শ্ববর্তী ‘বন্ধু রাষ্ট্র ভারত’ থেকে সীমান্ত পথে পাচার হওয়া মাদক এক পা দু’পা করে এ দেশের জনপদে ঢোকার মাধ্যমেই প্রথম মাদকের বিস্তার ঘটে। এক হাত দু’হাত ধরে হাত বদলের মাধ্যমে এই মাদক এতটাই বিস্তৃত, যার ভয়াবহতা আজ চরম থেকেও চরমে। ভারতীয় মাদকের বাংলাদেশ দখল দেখে লোভ সামলাতে পারে নি আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ‘মিয়ানমার’। ভারতীয়দের বাজার দখলে নিতে তারাও উঠেপড়ে লাগে। সুকৌশলে প্রবেশ করায় মাদক বড়ি ‘ইয়াবা’। আজ মাদকের বিশাল হাট ‘বাংলাদেশে’ ইয়াবার স্থান হয়েছে শীর্ষে যার পরিচয় ‘বাবা’। প্রতিবেশি এই দু’দেশের কল্যাণে আজ এ দেশের যে কোন স্থানেই হাত বাড়ালেই মাদক অনেক সহজলভ্য। মস্তিস্ক ও প্রাণধ্বংসী মাদকের বিস্তার ঘটেছে দশকের পর দশক। দেশজুড়ে মাদকের পাতানো জালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফাঁদে পড়েছে, নিঃস্ব হয়েছে। হয়েছে কোটি কোটি পরিবার মাদকের অভিশাপে জর্জরিত।
মাদকের ভয়াবহতা রোধে এবার শুরু হয়েছে ভিন্নধর্মী অভিযান। প্রতিবারই ঘোষণা দিয়ে অভিযান শুরুর পর ক’দিন বাদেই তার সমাপ্তি ঘটে। পরিচিত অভিযান ছাড়াও ঘোষণার বাইরে দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সারা বছরই মাদক নিয়ন্ত্রণের পেছনে ছোটে। কিন্তু সে সবের সফলতা কতটা, তা আজ মাদকের ভয়াবহতার চিত্রের কাছে প্রশ্নের দাবিদার।
সর্বশেষ উপায়হীন অবস্থার মধ্যেই দু’সপ্তাহ আগে শুরু হয়েছে ভিন্নধর্মী অভিযান। শুরুটা পুলিশের এলিট ফোর্স ‘র্যা ব’ করলেও কয়েকদিন বাদেই ওই ভিন্নধর্মী অভিযানে জড়ায় পুলিশও। পুলিশ-র্যা বের চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের দু’সপ্তাহের মাথায় এসেই ঘোষণা করা হয়েছে ‘অল আউট’ অভিযান। রাজধানীসহ সারাদেশেই এ অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ-র্যা ব।

এবারের পুলিশ-র্যা বের মাদক বিরোধী অভিযানের ভিন্নতা এনেছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এই বন্দুকযুদ্ধকেই শেষ ভরসা মনে করছে সরকারসহ আইনশৃংখলা বাহিনী। এর আগে মাদক নিয়ন্ত্রণের সকল প্রকার চেষ্টাই করা হয়েছিল। ফলাফল ছিল ‘শূন্য’। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ থেরাপিতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ-র্যা বের হাতে প্রতিরাতেই একাধিক ব্যক্তির প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটছে। দিনের পর দিন এই প্রাণ হারানোর সংখ্যা বাড়ছেই। গত ১৫ মে থেকে দেশজুড়ে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী অভিযানে গত ১৪ দিনে ৯৭ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
জানা গেছে, গত ১৫ মে ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে সরকারি বাহিনী ও সংস্থাগুলো। এর আগেও একাধিকবার ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান হয়েছে। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে, এবারে একের পর এক কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে, যাতে নিহত ব্যক্তিরা সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী বলে জানানো হচ্ছে।

অভিযানে বড় ধরনের মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার না হলেও গত ১৪ দিনে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৯৭ জন। অভিযানে অংশ নেয়া বাহিনীর একাধিক সদস্য বলেন, মাদক নির্মূলে এখন বন্দুকযুদ্ধকেই ভরসা বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। তাদের মতে, বন্দুকযুদ্ধকে যদি অপরাধ ও অপরাধী দমনের পন্থা হিসেবে বৈধ বলে গন্য করা হয়, কিংবা বৈধ করা হয়, তাহলে বিচার ব্যবস্থারই কোন অস্তিত্ব থাকে না। বন্ধ করে দিতে হয় বিচার ব্যবস্থাকে। বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ ও অপরাধী দমনে কার্যকর মনে করা না হয়, তাহলে এর দায় বর্তায় আইন বাস্তবায়নকারীদের ওপর এবং তা আইনের ওপরও। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে, শুধু অভিযান দিয়ে মাদক সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘এ জন্য দরকার মানুষের সচেতনতা। সেটা না হলে মাদক সমস্যা থেকে কোনো দিনই বের হতে পারব না।’

জানা গেছে, দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, র্যা ব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গত ১৪ মে সোমবার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নেয়ার আভাস দেন র্যা বের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যা বের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মাদক প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থায় যত কাঠামো আছে, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবে র্যা ব। কারও কাছে মাদক থাকলে তা র্যা বের ক্যাম্পের পাশে ফেলে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। এর আগে ৩ মে র্যা বের ১৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে র্যা বকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।

র্যা ব সূত্র জানায়, ৪ মে থেকেই র্যা ব বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।তবে মূল অভিযান শুরু হয়েছে ১৪ মে সোমবারে ঘোষণা দেুয়ার পর থেকে। ওই ঘোষণার পর থেকে এখন প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ রোববার রাতে সারাদেশে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৯ জেলায় ১২ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ২, নাটোরে ১, ঝিনাইদহে ১, ঢাকায ১, মুন্সিগঞ্জে ১, চাঁদপুরে ১, পিরোজপুরে ২, পাবনায় ১ ও সাতক্ষীরাতে ২টি ঘটনা ঘটে। এসব ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। রোববার দিবাগত রাত ১২ থেকে গতকাল সোমবার ভোর পর্যন্ত দেশের বিভিন্নস্থানে চলা এসব অভিযানে নিহতরা মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছে র্যা ব ও পুলিশ।
এর আগে ১৫ মে রাতে ২ জন, ১৭ মে রাতে ৩ জন, ১৮ মে রাতে ১ জন, ১৯ মে রাতে ৩ জন, ২০ মে রাতে ৪ জন, ২১ মে রাতে ৯ জন, ২২ মে রাতে ১২ জন, ২৩ মে রাতে ৮ জন, ২৪ মে রাতে ১২ জন, ২৫ মে রাতে ৯ জন, ২৬ মে রাতে ১১ জন, ২৭ মে রাতে ১১ জন আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
র্যা বের অভিযান শুরুর পর এর আগেও গত ৭ মে রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নারায়ণগঞ্জে ও কুষ্টিয়ায় একজন করে এবং ৯ মে রাজশাহীতে একজন নিহত হয়েছেন। এরাও সবাই মাদক ‘ব্যবসায়’ জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছে বাহিনীটি।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মনে করে, দেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৬ লাখের বেশি। এদের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরা ৪০ কোটির বেশি ইয়াবা বড়ি সেবন করছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে। হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক। এই বিপুল প্রক্রিয়া থামানোর কার্যকর উপায় নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। তবে বিগত বছরগুলোতে দেশে মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ছড়িয়েছে মহামারির মতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাদক নির্মূলে যে পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তাদের সদস্যদেরই মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের কোনো সদস্য মাদকে জড়ালে চূড়ান্ত শাস্তি বলে প্রকাশ্য আলোচনায় হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বন্দুকযুদ্ধকেই সমাধান মনে করছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর আগের অভিযানগুলোতে দেখা গেছে, মাদকের আড়তদারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। প্রভাবশালী এসব মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। যারা অভিযানের জালে ধরা পড়ছে, তাদের বেশির ভাগই ছিঁচকে বা নিচের স্তরের।

পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন বাহিনীর নেয়া তালিকাগুলো সমন্বয় করে একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা ধরেই অভিযান শুরু হয়েছে। এটা ধাপে ধাপে চলবে। মাদকসেবী ও খুচরা বিক্রি করছে যারা, এখন তাদের ধরা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে মাদক ব্যবসায়ী এবং যেসব এলাকা দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশ করছে, সেসব এলাকায় কঠোর অভিযান চালানো হবে। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কঠোর অভিযান বলতে তাঁরা বন্দুকযুদ্ধকেই বোঝাচ্ছেন।
কত দিনের অভিযান
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির জন্য এত জোরেশোরে অভিযান চলছে। যত দিন না পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে বা মনে হবে মাদকের বেচাবিক্রি কমেছে, তত দিন এ অভিযান চলবে। আপাতত তিন শতাধিক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে এ অভিযান পুরোপুরি বন্ধ হবে না, ধরন পাল্টানো হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমান বিচারিক ব্যবস্থায় মাদক নির্মূলে আর কোনো পদ্ধতি কার্যকর হবে না বলেই তাঁরা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড বা মেক্সিকোর অভিযানের উদাহরণ টানছেন তাঁরা। ওই সব দেশে মাদক নির্মূলের নামে কয়েক হাজার সন্দেহভাজনকে হত্যা করেছিল সরকারি বাহিনী। সেইভাবে শুরু হওয়া অভিযানকে সাধারণ জনগণ সমর্থন দিচ্ছে বলেও মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
কোন তালিকার ভিত্তিতে অভিযান?
অবৈধ মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে পুলিশ র্যা বের অভিযানে রোববার রাত পর্যন্ত ১৪ দিনে বিভিন্ন জায়গায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে ৯৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই অভিযান কি কোনো তালিকার ভিত্তিতে হচ্ছে? সে তালিকা কার করা? এ প্রশ্নে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য।

পুলিশ এবং র্যা বের সূত্রগুলো বলছে, তারা তাদের স্ব স্ব বাহিনীর তালিকা নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, সমন্বিত তালিকার মাধ্যমেই অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত নিহতদের দু’একজনের পরিবার ঘটনার প্রতিবাদ করে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরেছে। এর মধ্যে একজন চট্রগ্রামের পটিয়া এলাকার হাবিবুর রহমান মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়ার পর তার পরিবার সংবাদ সম্মেলন করেছে।
তার মেয়ে তানজিদা রহমান বলছিলেন, তার বাবা স্থানীয় কোন গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের শিকার বলে তারা বিশ্বাস করেন। ‘আমার আব্বুকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে, আমরা জানতাম না। পরে বরিশাল কলোনীর দুই জনের লাশ টেলিভিশনের খবরে দেখাচ্ছে। তখন দেখলাম আমার আব্বুর লাশ এবং তার হাতে সিগারেট। কিন্তু তিনি কোনদিন সিগারেট খেতেন না। আমার আব্বু মাদকের সাথে জড়িত ছিল না। কারণ আমার আব্বু বিদেশে ছিল কিছুদিন। বিদেশ থেকে আসার পর আব্বু কোর্ট বিল্ডিংয়ের কাছে নাস্তা বিক্রির দোকান করেছিল।’
ওই ঘটনার দু’দিন আগে অভিযানে নিহত হয়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়া এলাকার বাসিন্দা লিয়াকত আলী ম-ল।

তার স্ত্রী মেহের বানু বলেছেন, তাঁর স্বামী আগে মাদকের ব্যবসা করলেও তিনি সেই পথ ছেড়ে এসেছিলেন। এখন তাহলে কি কারণে তাঁর স্বামীর এই পরিণতি হলো, সেই প্রশ্ন তুলছেন মেহের বানু। ‘মানুষ খারাপ থেকে ভাল হয় না? ভাল হতে পারে। আমার স্বামী দোকান দিছে। এছাড়া গরুর ব্যবসা করতো। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিল সে।’
‘র্যা বের দুইজন এসে বলছে, তারা একটা গরু কিনবে, সেটা দেখে তাকে কিনে দিতে হবে। এই বলে আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর তার লাশ পাইছি। আমার স্বামীকে যে ষড়যন্ত্র করি নিয়া যায়া মারলো, এর কি বিচার হবে না?’ -প্রশ্ন করছেন তিনি।
নিহতদের সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তথ্য যাচাই করতে পারছে না। কারণ পরিবারগুলো ভয়ের মধ্যে আছে। বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনও মুখ খুলছে না।
ভিন্ন কথা
গবেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনেকের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে তারা।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, মাদক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশের অভিযোগও পুরনো।
চট্টগ্রামের এক নারী তার সন্তানের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে একজন ওসিসহ সাত পুলিশ সদস্যের মামলা করেছেন এক নারী- গত মাসের শেষ সপ্তাহে।
এমন পটভূমিতে দেশে কয়েকদিন ধরে যে অভিযান চলছে সেটি পুলিশ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘর থেকে শুরু হলেই তা মাদক নির্মূলে বেশি কার্যকর হতো বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন। তিনি বলেন, ‘এটা সফল হবে না যদি পুলিশ বা মাদকের যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো বা সমর্থন দিয়ে আসছিলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হয়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বার্তা দিতে হবে যে সরকার কাউকে প্রশ্রয় দেবেনা।’

এর সাথে একমত প্রকাশ করেন মাদকাসক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম ইমদাদুল হক। তিনি বলেন, ‘মাদকের এমন পরিস্থিতি তৈরির পেছনে পাচারকারীদের যেমন একটা ভূমিকা আছে- তেমনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও বিভিন্ন রকম প্রশ্ন গণমাধ্যমেও এসেছে। জনমনেও এটি নিয়ে বড় ধরনের সংশয় আছে। তাই একটা শুদ্ধি অভিযান আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও প্রয়োজন আছে। যদিও এটা সরকারের নীতিমালার ওপরই নির্ভর করছে।’

তবে পুলিশের মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেলী ফেরদৌস বলছেন, বাহিনীর অভ্যন্তরে মাদক বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে পুলিশ, তাই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।তিনি বলেন, ‘বিভাগীয় ব্যবস্থা তো রয়েছেই- পাশাপাশি অভিযোগ প্রমাণিত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
কিন্তু চলমান অভিযানে পুলিশের কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না কেন- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এবারের অভিযান বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে সব জায়গায় মাদক নির্মূলের জন্যই।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: জামাল উদ্দীন আহমেদ বলছেন, সংস্থার কেউ মাদকের সাথে জড়িত পাওয়া গেলে কোনভাবেই ছাড় দেবেন না তারা। তিনি বলেন, এর আগে একজন কর্মীকে মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে নিজেরাই আদালতে সোপর্দ করেছেন। তিনি বলেন, নিজস্ব ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই সবাইকে নজরদারিতে রাখা হয়- যাতে কেউ এ ধরনের কর্মকা- জড়িত হতে না পারে।

উদ্বিগ্ন আসক
সাম্প্রতিক সময়ে র্যা ব ও পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি নিহত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এসব ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলা হয়, গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে সম্প্রতি সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ‘শূন্য-সহনশীলতা’ নীতি গ্রহণ করেছে, যার অংশ হিসেবে মে মাসের শুরু থেকে র্যা ব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী সারাদেশে ব্যাপক মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। এ অভিযানে র্যা ব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে,এবং তা পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলছে। আসক কর্তৃক সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ মে পর্যন্ত ১০২ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

মাদক নির্মূলে বন্দুকের ব্যবহারে উদ্বেগ সুলতানা কামালের
মাদক দমন অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এতে হতাহতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। “কেন এই উপায়েই মাদক সন্ত্রাস দমন করতে হচ্ছে, অন্য কোনো উপায় কি নেই?” প্রশ্ন রেখেছেন তিনি। মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এক অনুষ্ঠানে এসে নিজের উদ্বেগের কথা জানান সুলতানা কামাল।

সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা তো একটা যুদ্ধের মধ্যে নেই। আমরা তো একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে বাস করছি। সেই জায়গায় এরকমভাবে দিনে ৫/৬ জন করে যদি বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়, সেখানে উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা।”
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, “এই জন্যই এ সমস্ত ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আমাদেরকে অবহিত করতে হবে। প্রত্যেকটা ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিৎ। “আসলেই এখানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছে কি না? কিংবা অন্য কোনোভাবে বন্দুকের অপব্যবহার হচ্ছে কি না? সেটাও আমাদের জানা দরকার। কারণ এই অস্ত্রটা আমরাই তুলে দিয়েছি তাদের হাতে।”

অপরাধী যেই হোক না কেন, তার আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, রাষ্ট্রের কতগুলো নিয়ম-নীতি রয়েছে, সে অনুযায়ী তাদের বিচার হতে হবে। এর মাধ্যমে কেউ দোষী প্রমাণিত হয় সেই জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য সেটা তাকে দিতে হবে।
‘বন্দুকযুদ্ধের’ সমালোচনা করলেও মাদকের মতো একটা ‘বিষাক্ত ব্যাপার’ দমনে কঠোর আইন করে তা প্রয়োগের আহ্বান জানান সুলতানা কামাল। “আমরাও চাই কঠোর আইন হোক, কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হোক। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা যে, আমাদের সংবিধান বলে তো একটা কথা আছে।”

http://www.dailysangram.com/post/332212