২৯ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩৮

ক্ষমতার খড়কে ভূলুণ্ঠিত গণতন্ত্র

অনেককাল হতে শুনে আসছি, গণমানুষের দ্বারা গঠিত শাসন ব্যবস্থার নামই ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্রের পরিভাষায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্রের ক্লাবে প্রবেশের অধিকার সংরক্ষণ করতে হয়। গণতন্ত্রের ক্লাবের কর্তাদের একদিকে যেমন গণতন্ত্র পন্থায় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে হয়। অপরদিকে তেমনই আইন সভায় জনস্বার্থ অক্ষুণœ রেখে টেকসই গণতন্ত্রের চর্চা করতে হয়। সাফ কথা, গণমানুষের অধিকারই হলো গণতন্ত্রের মর্মবাণী।

শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার খড়ক গণতন্ত্রের ওপর নেমে আসলে তখন স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্র কলুষিত হবে এটাই বাস্তব। নীতির কাছে ‘বিবেক’ যখন পরাজয় বরণ করে তখন বিবেক আর বিবেকের ঘরে বাস করে না। বরং বিবেক দ্রুত পালাতে যায় নির্বাসিত কোনো গুহায়। নীতির কাছে হার মেনে বিবেক যখন নির্বাসিত গুহায় আত্মগোপন করে তখন সব অনিয়ম-দুর্নীতিই হয়ে ওঠে যতো নিয়ম-নীতি। ফলে নীতি বহির্ভূত কাজকর্ম সমাজের চারদিকে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে নির্ভেজাল অনিয়ম-দুর্নীতির কবলে দেশের শাসন ব্যবস্থা নিমজ্জিত হতে থাকলে।
আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্র পন্থায় পরিচালিত হওয়ার কথা। এটা আমার ব্যক্তিগত যেমন কোনো অভিমত নয়। তেমনই নতুন কোনো চিন্তা-ফিকিরও নয়। বরং এটি বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু বহু আকাক্সিক্ষত আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রকে বারংবার অপব্যবহারের তলানিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

বলা বাহুল্য যে, প্রতিবারই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য, অরাজকতা, দেশের মালিক খ্যাত জনগণের জানমাল ধ্বংস ও সহিংসতার তাণ্ডব চলতে দেখা যায় আমাদের গণতান্ত্রিক নামের এই স্বাধীন বাংলাদেশে। সর্বশেষ দশম জাতীয় নির্বাচনেও এর কোনো প্রকার ব্যত্যই ঘটেনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাকে কব্জা করার হীনমানসে দানবের ন্যায় ক্ষমতার খড়ক বাজিয়ে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করতে একটুও দ্বিধা করেনি। বরং অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ক্ষমতার খড়কে গণতন্ত্রকে কলুষিত করে পাতানো তামাসার নির্বাচনে তথাকথিত বিজয়ের ধুয়া তুলে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অপহিম্মত দেখিয়েছে।

আমরা মনে করি, যে কোনো প্রকার সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ গণতন্ত্র পরিপন্থি। এসব ধ্বংসযজ্ঞ কর্মকা- গণতন্ত্র অনুমোদন করে না। গণমানুষের স্বার্থহানি ঘটে এমন কোনো কাজ গণতন্ত্রে বিন্দু মাত্রও ঠাঁই নেই। গণতন্ত্র যখন সঠিক পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন দেশে নানাবিধ সঙ্কট বিরাজ করতে দেখা যায়। যেমনটি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যূকে কেন্দ্র করে দেশে নৈরাজ্য, অরাজকতা, জানমাল ধ্বংস ও সহিংসতার পর ক্ষমতার ক্যারিশমায় সব ধরনের নির্বাচনে ‘ক্ষমতাসীনরাই জয়ী’ এমন অপ্রত্যাশিত নীতি বাস্তবায়ন হওয়ায় বাস্তবিকপক্ষেই দেশ গভীর সঙ্কটময় সময় অতিবাহিত করছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে এমনটাই বাস্তব। গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে ব্যক্তি নয়, আইনের শাসনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালিত না হলে কোনোক্রমেই টেকসই উন্নতির আশা করা যায় না।

নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ ও মেরুদন্ডহীন হিসাবে আখ্যায়িত করলে কোনো প্রকার দোষ নয় বলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। কারণ নানাবিধ বাধাবিঘœ পেরিয়ে বিশেষ করে ১৯৯১ সাল থেকে এ দেশে গণতান্ত্রিক যে নির্বাচন বিধিব্যবস্থা চলে আসছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের হাতে তার অপমৃত্যু ঘটার বাকী নেই। আর এই গণতন্ত্র বিনাশের ক্ষেত্রে দোসর হয়েছে মেরুদন্ডহীন ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন।
এ ক্ষেত্রে আমরা আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি, গণবিরোধী প্রক্রিয়া বন্ধ করার সাধ্য না থাকলে ইলেকশন কমিশনের স্বপদে থাকার স্বার্থকতা না থাকাটাই স্বাভাবিক। সংবিধানের দোহাই দিয়ে ভোট, ভোটার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক কারসাজির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী এবং গণতন্ত্রকে পরাজিত ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের প্রক্রিয়া চালাতে কোনো প্রকার দ্বিধা করেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

ভোটাধিকার গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক নীতির একটি। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করা দেশের প্রতিটি ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১২২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি ভোটারের ভোট দেয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে সংসদের ৩০০ জন প্রতিনিধিই সরাসরি জনগণের ভোটের মাধমে নির্বাচিত হবে। তবে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের ভোটের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।

বাস্তব অবাস্তব হলেও সত্য। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী কোনো ভোট ছাড়াই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ অবস্থায় বাকি ১৪৬ টি আসনের জন্য নির্বাচনে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাক বা না যাক তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে কোনো দল কিংবা জোট ১৫১টি আসন পেলেই সরকার গঠন করতে সক্ষম।

বাকি ১৪৬ টি আসনের জন্য ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতেও নিশ্চিত করে বলা যায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশিরভাগ আসনে বিজয়ী হয়েছে। আর যদি অন্য কেউ কোনো আসন থেকে বিজয়ী হতে চেয়েছেন তাহলে তাকে অবশ্যই আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়েই বিজয়ী হতে হয়েছে। কারণ প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনকে বর্জন করায় ওই আসনগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার মতো কোনো প্রার্থী ছিলো না বললেই চলে।

এসব নানাবিধ কারণেই ওই নির্বাচনে ভোটারদের আর তেমন কোনো গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। এমন একটি পরিস্থিতিতে আর যাই হোক, সরকার এই বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে যে, তাদের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে, ওইসব আসনে তাদের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো প্রার্থীই নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক হিম্মত দেখাতে পারেননি। সুতরাং ওই নির্বাচনে যে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি তা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় বলা হয়েছে, জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে ভোটের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা হতে হবে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে মাধ্যমে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি দেশে যে নির্বাচন হয়েছে তা কোনো মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের মধ্যে পড়ে কি-না সে প্রশ্নের জবাবটাই এখন গুমরে মরছে।

ভোটার ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা কেনো অবৈধ হবেন না তা দাবি করে ইতোমধ্যে এক আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন। তিনি তার রিট আবেদনে উল্লেখ করেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা অনুসারে, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর বা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর একক প্রার্থী থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের কোনো বিধান রাখা হয়নি। অথচ সংবিধান স্পষ্ট বলছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়া কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করা সংবিধানের পরিপন্থী। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা সংবিধানের ৭, ১১, ২৭, ৩১, ৬৫ (২), ১২১ ও ১২২ (২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।

আমরা মনে করি, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ইলেকশন নয়, সিলেকশন হয়েছে। যার দরুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রহসনের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা অনেক আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিল। অন্যরাও জনগণের অধিকার হরণের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার বদলে গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। শুধু দেশে নয়, বিশ্বসমাজও ওই নির্বাচনী প্রহসনকে বৈধতা দিতে রাজি নয়। এসব নানাবিধ কারণেই দশম সংসদ নির্বাচনে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো স¤পৃক্ততা ছিল না। সেকারণে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল’ এর গুণাবলী বহন করে না। বিপরীতে ওই নির্বাচন হয়েছে ‘বাই দ্য ইলেকশন কমিশন, ফর দ্য আওয়ামী লীগ, অব দ্য আওয়ামী লীগ।’

আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অনিশ্চয়তার দিন ঘুচাতে এবং প্রগতির দিকে এগোনোর পথ দেখাতেই সামনের দিনে চিন্তা-ভাবনা করে ‘ভোটাধিকার’ ব্যালটে প্রয়োগ করাই হবে প্রতিটি নাগরিকের গুরুদায়িত্ব। তবে প্রশ্ন ওঠতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির। জবাবে বলা যেতে পারে, জনগণ যদি দেশের মালিক সমতুল্য হয়ে থাকেন, তবে সব কিছুই মোকাবেলা করতে খোদা চাহে জনগণই সক্ষম হবেন এমনটাই বাস্তব।

রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান কিভাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কিন্তু বিবেক যদি বিবেকের ঘরে ফিরে আসে তবে নিশ্চয়ই নিজেরসহ দেশের এবং দশের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। ফলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যেমন সহজতর হবে। তেমনই বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে সচল করে তুললেও যথেষ্ট সহায়ক হবে। এমনটাই আশা আমাদের।
dulonbiswas@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/332259