২৮ মে ২০১৮, সোমবার, ৯:২৭

যানজট, নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা

পরিকল্পনাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ


ঢাকার রাস্তায় প্রাণঘাতী বাসগুলোকে শৃঙ্খলায় আনার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত পরিকল্পনাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ অভিযোগ খোদ পরিকল্পনা প্রণেতাদেরই।


ঢাকা মহানগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৭৪টি রুটে ২৪৬টি কোম্পানির তিন হাজার মালিকের পৌনে আট হাজার বাস চলে। একই রুটে বাস চালায় একাধিক কোম্পানি। তাদের মধ্যে যাত্রী পেতে চলে রেষারেষি, ব্যস্ত সড়কে গতির প্রতিযোগিতা। একই কোম্পানির ভিন্ন মালিকের বাসে বাসেও চলে এ রেষারেষি। বাসগুলো মোড় বন্ধ করে যত্রতত্র যাত্রী তোলে। এ কারণে লেগে থাকে যানজট। আবার ফুটপাতের পাশের লেন দখলে বাসে বাসে 'লড়াই'য়ে প্রাণ যায় যাত্রীর।


সম্প্রতি রাজধানীতে কয়েকজনের মৃত্যু ও অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটেছে এই বাসের লড়াইয়ে।


গত বছরের ১৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুলের হক বিশৃঙ্খল গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।


ওই সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, ঢাকায় রুটের সংখ্যা কমিয়ে ২২ করা হবে এবং ২৪৬টি কোম্পানিকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানি গঠন হবে। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রঙ হবে ভিন্ন। পুরনো বাসের বদলে ঢাকায় নামানো হবে চার হাজার নতুন বাস। এ পদ্ধতিতে একটি রুটে একটি কোম্পানির বাস চলবে। কোম্পানির অধীনে চলা বাসগুলো সমানভাবে মুনাফা পাবে। নির্ধারিত সময় অন্তর বাস আসবে। তাই যাত্রী পেতে রেষারেষি থাকবে না, সড়কে প্রতিযোগিতাও থাকবে না। মোড় 'দখল' করে যাত্রী তোলার প্রণবতা দূর হলে যানজটও কমবে।


কিন্তু গত ডিসেম্বরে আনিসুল হকের মৃত্যুতে 'বাস রুট পুনর্বিন্যাস' নামে এ উদ্যোগ গতি হারিয়েছে। গত জানুয়ারিতে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সিদ্ধান্ত নেয়, দুই সিটি করপোরেশন 'বাস নেট' নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। সমন্বয় করবে ডিটিসিএ। পরীক্ষামূলকভাবে বিমানবন্দর থেকে সায়েদাবাদ ভায়া কুড়িল থেকে পূর্বাঞ্চল-২ রুটে 'উন্নতমানের বাস সার্ভিস' চালু করা হবে।


বাস রুট পুনর্বিন্যাস উদ্যোগের পরামর্শক এবং ডিটিসিএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক এস এম সালেহ উদ্দিন সমকালকে জানান, তিনি ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক থাকাকালে আজিমপুর থেকে উত্তরা পর্যন্ত বাস সার্ভিস চালু করেছিলেন। কিন্তু সেটা সফল হয়নি অন্য রুটের বাস মালিকদের চাপে। তার মতে, ডিটিসিএর পরীক্ষামূলকভাবে বাস চালুর নতুন উদ্যোগও সফল হবে না। তিনি বলেন, পুরো শহরকেই একসঙ্গে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। একটি রুটে পরীক্ষামূলক বাস চালু করলে ওই রুটে চলাচলকারী অন্যান্য বাসের কারণেই সেটা ব্যর্থ হবে।


সালেহ উদ্দিন সমকালকে জানান, উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ২০১৬ সালে তারা সমীক্ষা পরিচালনা করেন। কোন রুটে কতগুলো বাস প্রয়োজন, কোথায় বাস স্টপেজ প্রয়োজন, চারটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের উন্নয়ন, ছয়টি সিটি টার্মিনাল নির্মাণে জায়গা নির্ধারণসহ অনেক কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছিল। পুরো পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকারকে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আনিসুল হককে। তিনি বলেন, কারও মৃত্যুতে প্রকল্প আটকে থাকতে পারে না। ঢাকার বিশৃঙ্খল বাস ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।


বাস রুট পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনায় যুক্ত অনেকেই সমকালকে জানিয়েছেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল পরিবহন মালিকদের রাজি করানো। তাদের আশঙ্কা ছিল, পুরনো কোম্পানি ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সারা শহরের জন্য মাত্র ছয়টি কোম্পানি হলে তাদের লোকসান হবে। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ সমকালকে বলেন, একের পর এক সভা করে মালিকদের পুরো পরিকল্পনা বুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছিল। তারাও পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পর কী হচ্ছে, তা আর জানি না।


প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকায় একটি সমীক্ষা করা হয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের প্রাক-উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) প্রণীত হয়েছে। ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহমেদ সমকালকে জানিয়েছেন, পিডিপিপি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।


পিডিপিপির তথ্যানুযায়ী, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে বিমানবন্দর থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল সেক্টর-২ পর্যন্ত সাত কিলোমিটার দীর্ঘ বাস করিডোর চালু করা হবে। এতে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১০৫টি আর্টিকুলেটেড বাস চলবে। প্রতিটি বাসের যাত্রী ধারণক্ষমতা ১৪০।


বিভিন্ন দেশে বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি (বিএফএস) নামে কার্যকর রয়েছে বাস করিডোর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যানজট কমেছে সিঙ্গাপুর, দিল্লি, সিউল ও চিলিতে। এ পদ্ধতিতে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয় না। সড়কে বাসের জন্য পৃথক লেনও নির্মাণ করতে হয় না। শুধু ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করতে হয়।


পিডিপিপি অনুমোদনের পর মন্ত্রণালয় ডিপিপি প্রণয়ন করবে। সেটা পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেলে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেকে যাবে। সেখানে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হলে ঢাকার গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলাও দীর্ঘ হবে, মন্তব্য সংশ্নিষ্টদের।


এদিকে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাস রুট পুনর্বিন্যাস কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সংশ্নিষ্টদের তাগিদ দেওয়া হয়।


বারবার শুধু তাগিদেই সীমাবদ্ধ থাকছে উদ্যোগ। এ ব্যাপারে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাসছুল হক। তিনি সমকালকে বলেন, ঢাকাকে বাঁচাতে আরও আগে এ বাস রুট পুনর্বিন্যাস করা, রুটভিত্তিক কোম্পানি, অপারেটর ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজন ছিল। যা উন্নত বিশ্বে 'বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি সিস্টেম' নামে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় বাসকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রাইভেট কারবান্ধব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।


যানজট নিরসনে ২০০৪ সালে প্রকৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) নামে মহাপরিকল্পনা করে সরকার। পরিকল্পনাবহির্ভূত প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ বছর মেয়াদি এসটিপি ব্যর্থ হয়। গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) প্রণয়ন করা হয়। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় দুই লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আরএসটিপিতে পাঁচটি মেট্রোরেল, বাসের জন্য দুটি পৃথক লেন (বিআরটি) নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বিআরটি-৩-এর একাংশ; জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটির নির্মাণকাজ চলছে।


ডিটিসিএর পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, মেট্রোরেল ও বিআরটি ১৭ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করবে। বাস খাত সংস্কার করে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারলে তার চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে।

http://samakal.com/capital/article/18051638