২৭ মে ২০১৮, রবিবার, ১১:২৭

সরকারের অবাস্তব করবিরোধী বাজেটে ন্যূব্জ এনবিআর

আর্থিক চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিশাল করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে সরকার। আপত্তি সত্ত্বেও দেয়া করের বোঝা বহনে অক্ষম হয়ে পড়েছে এনবিআর। রাজস্ব আদায়ের এ ভার কমানোর আবেদন জানালেও আপত্তি আমলে নেন না অর্থমন্ত্রী। কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। ফলে সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছে তা থেকে পিছু হটছে। বছরের শেষ মুহূর্তে এসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কাটছাঁট হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এ বছরও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের বাজেট পরিকল্পনা অনেকখানিই নির্ভরশীল রাজস্ব আয়ের ওপর। সেই রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। আবার এনবিআরকে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়ায় মাঠ পর্যায়ে কর কর্মকর্তারা হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আবার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এনবিআরকে সরকারের চাপিয়ে দেয়া কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব যা আদায়যোগ্য নয়। এ অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা এনবিআরের পক্ষে সম্ভবও না। সব মিলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের এ এ খাতটিতে এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে।

জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বিশাল আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছে। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে দেখা যায় আদায় লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই থাকে। এর পর বছরের শেষ দিকে এসে তা সংশোধন করে কমিয়ে আনা হয়। গত চার বছর ধরে এটি একরকম নিয়মেই পরিণত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুতে বিশাল রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও অর্থবছরের শেষ দিকে এসে তাতে বড় ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে বিগত বছরগুলোর মতই রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে না। আগামী বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী সংশোধিত রাজস্বের এ তথ্য জানাবেন। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। কিন্তু বিগত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। বছর শেষে এর পরিমাণ আরও বাড়াবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা করা হতে পারে। এদিকে অর্থনীতিবিদরাও চলতি অর্থবছর শেষে ঘাটতি ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন। আর এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব হিসাবে ধরলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশাল বাজেট দেওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এটা দুঃখজনক। কেন না বছর শেষে দেখা যায় আয় কিংবা ব্যয় কোনোটির লক্ষ্যই অর্জন হয় না। তিনি বলেন, চলতি বছর রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। হয়তো ২০ শতাংশ হতে পারে। বেশি প্রবৃদ্ধি ধরাও গত কয়েক বছর ধরে নিয়ম হয়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বিশাল বাজেটের ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর এনবিআরকে ব্যাপক রাজস্ব আদায়ের তার্গেট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো বছরই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা আদায় হচ্ছে না। মাঝপথে এসে নিরুপায় হয়ে লক্ষ্যমাত্রা কমাচ্ছে সরকার। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয় ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর রাজস্ব আদায় ধরা হয় ২ লাখ ১০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। যার মধ্যে এনবিআর কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। বছরের শেষের দিকে এসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্ক দেখা দেয়। তখন সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় তা সংশোধন করে ২৮ শতাংশ কমানো হয়। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ বছর রাজস্ব আদায়ে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও ১৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর বাজেটের ৬০ ভাগ অর্থায়নের রেকর্ড দায় চাপানো হয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনবিআর রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের পথে হেঁটেছে সরকার। একই কারণে প্রত্যেক অর্থবছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনে বাধ্য হচ্ছে সরকার। তারপরও সরকার অবস্থান পাল্টায়নি। পরবর্তী অর্থবছরেও বাজেটের বড় অংশ অর্থায়নের দায় চাপানো হয় এনবিআরের ওপর। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মাঝপথে এসে দেশের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয় ২৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এর ফলে এ অর্থবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি থেকে কমিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭২০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
আর এ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এরপর অর্থবছরের মাঝে এসে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। পরে তা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৭২০ কোটি টাকায়। এনবিআরের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা। এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বিষয়ে এনবিআর জোরালো আপত্তি জানালেও অর্থমন্ত্রী নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন।

এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। এ অর্থবছরেও নেয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ঘাটতি মেটাতে মাঝপথে এসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে সরকার। এই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের হিসাবে, গত পাঁচ অর্থবছরে গড়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত তিন অর্থবছরে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, আর সর্বশেষ গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৯ শতাংশ। অথচ গত তিন চার অর্থবছর জুড়েই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছি কিংবা বেশি ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই আদায়যোগ্য ও বাস্তবসম্মত রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার আদায় করতে না পারলেও অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা রাখতে তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ৩০ শতাংশের উপরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব ও অর্জনযোগ্য নয় মন্তব্য করে বলেন, বাস্তবতার নিরিখে ৩৫ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কার্যত অসম্ভব। বাজেটে রাজস্ব আদায়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাহবা আদায় করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা জনমনে গুরুত্ব হারাবে।
এ ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, চলতি বছর রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ হবে না। এ লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ২৫ হাজার থেকে ৩০ কোটি টাকা কমিয়ে আনা হতে পারে।

এবারের প্রাক বাজেট আলোচনায় এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এনবিআরকে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ায় মাঠ পর্যায়ে কর কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের উপর হয়রানি বাড়িয়ে দেন। জনগণ যাতে বৃহৎ বাজেটের ভার সহ্য করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বড় রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের উপর আইন ও বিধি-বিধানের অপপ্রয়োগ, জুলুম ও হয়রানি বাড়ছে। এছাড়া খাতভিত্তিক ব্যবসায়ীরাও মাঠ পর্যায়ে কর বা ভ্যাট আদায়কারী কর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানির অভিযোগ করেন।
এদিকে অতীত অতীতই রয়ে যাচ্ছে। তার থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়া হচ্ছে না। প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ে কাটছাঁট চললেও আগমী অর্থবছরেও বিশাল রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে এনবিআরকে। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাজেটে বিশাল রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত প্রাপ্তি প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৩ হাজার ১১২ কোটি টাকা।

http://www.dailysangram.com/post/332008