২৪ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৪

নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি ব্যাংক পরিচালকদের

ব্যাংকের পরিচালকরা যাতে জোরজবরদস্তি করে নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারেন সে জন্য নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ সীমিত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এতেও পরিচালকরা নিবৃত্ত হননি। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালক ধরে সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। আবার নিজের ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালককেও ঋণ পাইয়ে দিচ্ছেন। এভাবে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিলেও এর বিপরীতে তেমন কোনো জামানত রাখতে হচ্ছে না। তুলনামূলক কম সুদে ঋণ নিয়েও পরে ওই টাকা পরিশোধ না করায় ওই ঋণ আদায় করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জামানতবিহীন ঋণ আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না।

জানা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। তাঁদের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ায় অনায়াসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে পারছেন তাঁরা। তা ছাড়া সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্যান্য সাধারণ ঋণগ্রহীতার চেয়ে সস্তায় ঋণ পাচ্ছেন। এত সুবিধা পাওয়ার পরও অনেক পরিচালক ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না।
ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, খেলাপি ব্যক্তি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে বা থাকতে পারবেন না—এমন নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অসাধু এসব পরিচালক ঋণখেলাপি হওয়ার পরও পদ ধরে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য ওই ব্যক্তিকে খেলাপি দেখানো যাবে না—এমন স্টে অর্ডার নিয়ে পরিচালক পদে বহাল থাকছেন তাঁরা।

এ নিয়ে পাওনাদার ব্যাংকগুলোকে শেষমেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। কেননা ব্যাংক পরিচালকদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী। তাঁরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন এক বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের ১৭-১৮টি ব্যাংক থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংক পুনর্গঠনও করে দিয়েছিল ২০১৫ সালে। অথচ ওই ঋণ পুনর্গঠন না করে খেলাপি হিসেবে দেখানো হলে বর্তমানে তাঁর পরিচালক পদই থাকত না। নতুন করে ঋণও পেতেন না তিনি।
জানা গেছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক পরিচালকের প্রাইম ব্যাংক থেকে নেওয়া ৭৩ কোটি টাকার ঋণ সম্প্রতি খেলাপি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় টাকা আদায় করতে না পেরে সম্প্রতি
প্রাইম ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে কী করণীয় জানতে চেয়ে। এভাবে পরিচালকদের কুক্ষিগত হচ্ছে ব্যাংকের ঋণের টাকা। পরে তাঁরা এই টাকা দিয়েই ব্যাংকের শেয়ার কিনে পরিবারের অন্য সদস্যদের পর্ষদে বসাচ্ছেন। ব্যাংকে কায়েম হচ্ছে পরিবারতন্ত্র। চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এক পরিচালকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ছয়টি ব্যাংকে থাকা ৯২৮ কোটি টাকার ঋণও পুনর্গঠন করা হয়েছিল। এর ফলে কম সুদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের সুবিধা পেলেও ওই ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশও এখন খেলাপি রয়েছে। খেলাপি ঋণের দায়ে নতুন ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়ালের পরিচালকের পদ হারিয়েছেন কামরুন নাহার সাথী।

এ রকম অনেক ব্যাংক পরিচালকই এখন ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক পরিচালকদের নেওয়া চার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে কোনো পরিচালকের নাম বা সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু ব্যাংকের সংখ্যা উল্লেখ করে গত সেপ্টেম্বরভিত্তিক ঋণের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালকদের মোট ঋণ রয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের সাত লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে যা ১৯.৬০ শতাংশ। পরিচালকদের বিপুল অঙ্কের ঋণের মাত্র তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা রয়েছে নিজেদের ব্যাংকে। বাকি ঋণ নেওয়া হয়েছে অন্য ব্যাংক থেকে।
অনেক পরিচালক আদালতের নির্দেশে খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোরও সুযোগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে পরিচালকদের বেনামি ঋণও রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, খেলাপি পরিচালকদের বোর্ড থেকে অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। এ ধরনের পরিচালকদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে দ্রুততম সময়ে তাঁদের অপসারণ করতে হবে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে যাতে তাঁরা সময়ক্ষেপণ করতে না পারেন সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো উদ্যোগী হতে হবে। দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে দ্রুততম সময়ে এ ধরনের রিট মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ব্যবসার জন্য পরিচালকরা ঋণ নিতেই পারেন। এসব ঋণ যথাযথভাবে নেওয়া হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ একটি সেল গঠন করা যেতে পারে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকাকালে সমঝোতার মাধ্যমে অনৈতিক ঋণ দেওয়া-নেওয়ার অভিযোগে ৩৪ জন ব্যাংক পরিচালককে অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সে ধরনের উদ্যোগ আর দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯টি ব্যাংকের পরিচালকরা যার যার ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ ছাড়া অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া পরিচালকদের ৫৩টি ব্যাংকে এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। পরিচালকদের খেলাপি হয়ে যাওয়া চার হাজার কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই অন্য ব্যাংকের।

ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো পরিচালক তাঁর ধারণকৃত শেয়ারের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন নিজ ব্যাংক থেকে। এ রকম ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) জানাতে হয়। পরিচালকের নেওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে তাঁর শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে ঋণের টাকা সমন্বয় করার বিধান রয়েছে। এসব কারণে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে তেমন আগ্রহ দেখান না পরিচালকরা। অবশ্য নিজ ব্যাংকে বেনামি ঋণ নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটে থাকে, যা বেআইনি।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকরা যোগসাজশের মাধ্যমে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। পরিচালক হওয়ার সুবাদে তাঁরা তুলনামূলক কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করিয়ে দেন। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধের সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যান অনেক পরিচালক।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার এক মাস পরও এবং নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়নি। গত এপ্রিলে সরকারি আমানত ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান করা হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের নগদ জমার বাধ্যবাধকতা (সিআরআর) ৬.৫ থেকে কমিয়ে ৫.৫ করার ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য ফেরত এসেছে। কিন্তু তার পরও ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৪-১৫ শতাংশ রয়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে, আগামী বছরের মার্চের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয় করতে হবে। এ কারণে নির্ধারিত অনুপাতের বেশি ঋণ রয়েছে এমন ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে; যে কারণে আমানতের সুদের হার চড়া। এ কারণে ঋণের সুদের হারও কমানো যাচ্ছে না।

গত ১৬ মে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংকের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের মেয়াদপূর্তি হওয়া আমানতগুলোও আমরা রাখতে পারছি না। কারণ আমরা তাকে সুদ অফার করছি ১০ থেকে ১০.৫ শতাংশ। কিন্তু কিছু নামকরা ব্যাংক এখন আমানতের সুদহার অফার করছে ১১.৭৫ শতাংশ। এখন আমরা যদি ১১ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করি এবং এর মধ্যে থেকে যেহেতু আমানতের প্রায় ১৮ শতাংশই বিনিয়োগ করা যায় না, সেহেতু আমানতের সুদের হার পড়ে ১১.৭৫ শতাংশের মতো। এর সঙ্গে ২.৫ শতাংশ তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ যোগ করলে প্রায় ১৪ শতাংশ পড়ে সুদের হার। বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসা আছে, যেখানে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা লাভজনক করা সম্ভব?’

এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুন নেওয়াজ সেলিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসার কথা বলছেন। যেহেতু আমরাও ব্যবসায়ী, ব্যাংকের বেশির ভাগ পরিচালকই ব্যবসায়ী, আমরাও প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাই।’
ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না কেন—এ প্রশ্নের জবাবে নূরুন নেওয়াজ সেলিম বলেন, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিষয়টি এখনো পুরোপুরিভাবে চালু হয়নি। ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) এক বৈঠকেও সম্প্রতি এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসে বিষয়টির নিষ্পত্তি করবেন। কেননা সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে যে আমানত পাওয়া যাচ্ছে, সেটারও কিন্তু চড়া সুদ। ১০.৫ শতাংশ, ১১ শতাংশ সুদে অনেক ব্যাংক সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। এত চড়া সুদে ব্যাংকগুলো যদি আমানত সংগ্রহ করে, তবে তারা সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেবে কিভাবে? তিনি আরো বলেন, দ্রুতই এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করার জন্য বিএবির নেতাদের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। যেহেতু এ বিষয়ের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারটাও জড়িত, সেহেতু এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য নীতিমালা প্রয়োজন রয়েছে।

এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরাও চাই ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসতে। বর্তমানে ১৩-১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। আমরা নিজেরাও ব্যবসায়ী। আমরা বুঝি এটা। আশা করছি, অতি দ্রুত এর একটা সমাধান আসবে।’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/05/24/639800