২৪ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৭

বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ॥ ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতার সম্মুখিন হতে হয়। বিভিন্ন শর্তের জালে আটকে ঋণ পেতে অনেক বিলম্ব হয়। প্রয়োজনমতো ঋণ পাওয়া যায় না। ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হয়। এ কারণে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশী ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেড়েই চলেছে বিদেশী ঋণের পরিমাণ। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, বাংলাদেশে বিদেশী ঋণ নেওয়া শুরু হয় ২০০৬ সালে। ওই বছর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়। গত কয়েক বছরে এ ঋণ বাড়ছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের দিকে ব্যাংকে উচ্চ সুদ, ব্যাংক ঋণ নিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে বেশি খরচসহ আরও কয়েকটি কারণে সৃষ্ট সংকট কাটাতে বিদেশী ঋণের অনুমোদন দেয়। আর এ ধারা অব্যাহত থাকায় পরিমাণ বেড়েই চলেছে। যা এখন উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বিদেশী ঋণের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণ করে সিপিডি জানায়, ২০১১ সালে ২৪টি ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় যার পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় ১৩৪টি। দেশের ব্যবসায়ীরা সরাসরি বিদেশী সংস্থা থেকে অথবা দেশী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং (ওবিইউ) থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এ বছর মোট ঋণের ৫৯ শতাংশ ছিল অফশোর ইউনিট থেকে। বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি নিচ্ছে পোশাক খাত। গতবছর দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ হিসেবে ১৪৯ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার এসেছে যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিদেশী ঋণ বাড়ার পাশাপাশি ঋণের সুদহারও বাড়ছে। ২০১৭ সালে বেসরকারি খাত গড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ সুদে ঋণ পেয়েছে, যা সবচেয়ে কম ছিল ২০১৫ সালে (৩ দশমিক ১ শতাংশ)। ২০১৬ সালে বিদেশী ঋণের সুদহার কিছুটা বেড়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হয়। অবশ্য বিদেশী ঋণের এ সুদহার দেশী ব্যাংকের চেয়ে অনেক কম। দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে এখন ৮ থেকে ৯ শতাংশ, কোনো কোনো ব্যাংক ১০ শতাংশেরও বেশি সুদ নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ বেসরকারি খাতে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। রপ্তানিকারকদের দাবির প্রেক্ষিতে বিদেশী ঋণ নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথম দিকে এ ঋণের কিছু অপব্যবহার হয়েছিল। এখন এ ধরণের ঘটনা ঘটছেনা। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নজরদারিতে রয়েছে।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, আমাদের যে সম্পদ আছে তাতে আমাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমাদের ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানে নানা রকম অনিয়মের কারণেই বিদেশী ঋণ নিচ্ছে বেসরকারি খাত। পরবর্তীতে এসব ঋণ আমাদের অর্থনীতির জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। আগে যতগুলো আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে সেখানে দেখা গেছে, স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম খরচে বড় করা হয়। বড় করে যখন ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হতো তখন যদি স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে তখন লেনদেন ভারসাম্যে সমস্যা দেখা দেয়। তাই বাংলাদেশকে যাতে এ ধরনের সমস্যায় না পড়তে হয় সেদিকটি বিবেচনা করতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতিতে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কেন না বিদেশী ঋণে অনেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত ৫ বছরে দেশে ২৪ শতাংশ হারে বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণ বাড়ছে। বর্তমান সরকারের সময়ে বেসরকারি খাতে ২০১২ সালে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৩ কোটি ডলার। ২০১৩ সালের ৪০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক ঋণ নেয় দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ডলারে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১৬ কোটি ডলার। ঋণের প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশের বেশি। আর ২০১৭ সালে সব রেকর্ড ভেঙ্গে তা বেড়ে এক হাজার ১৩৪ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। এ ঋণের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) বাইরে বিদেশী ঋণের অর্থায়নের বড় উৎস ওবিইউ। বিদেশী ঋণের তহবিলের মাত্র ৩ শতাংশ জোগান আসছে ওবিইউর নিজস্ব আমানত থেকে। অন্য ব্যাংকের ওবিইউ থেকে আসছে ৪ শতাংশ। ব্যাংকের ট্রেজারি থেকে আসছে ২৪ শতাংশ। বাকি ৬৯ শতাংশ আসছে বিদেশী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণ থেকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণের ১১ ধরনের ঝুঁকির কথা বলা হয়। এ গুলো হলো- বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি, নৈতিকতার ঝুঁকি, ঋণের খরচ, স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ, ঋণের সঠিক ব্যবহার, নীতিগত অনিশ্চয়তা, নীতি সহায়তা, ভেরিফিকেশন অব অ্যাপ্লিকেশন, বরোয়িং ফ্রম অফ শোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা। এতে আরও বলা হয়েছে- বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৪ শতাংশ বিদেশী ঋণ পোশাক খাতে। এরপর বিদ্যুতে ২১ শতাংশ, সুয়েটারে ১৬ শতাংশ, ডায়িং ও নিট গার্মেন্টসে ১২ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১১ শতাংশ, প্ল্যাস্টিকসে ৫ শতাংশ, সেবায় ৩ শতাংশ ও ওষুধে ২ শতাংশ।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে মিলিয়ে রপ্তানি বাড়লে বিদেশী ঋণ বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাংলাদেশে ঘাটতি সব সময় থাকে। তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশে আমদানি যে হারে বাড়বে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় সে হারে বাড়ার সম্ভাবনা কম। সেই দিক চিন্তা করলে বিদেশী ঋণ বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাংকের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের প্রতিযোগিতায় সক্ষম করা। সে ক্ষেত্রে তাদের চেষ্টার ঘাটতি আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলী বলেন, মালয়েশিয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের ঋণে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে যেসব ঝুঁকি রয়েছে তা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/331566