২৩ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:৩৬

অচল শহর ঢাকা

থমকে দাঁড়াচ্ছে যান চলাচল, ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে রাজধানীর জীবনযাত্রা। আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে যানজটপ্রবণ শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। রাজধানীতে গাড়ির গতি কমছে বছর বছর। গত এক যুগে ঘণ্টায় গড়গতি ২১ কিলোমিটার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কিলোমিটারে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং রাজধানীতে দেড় যুগে সাতটি ফ্লাইওভার নির্মাণেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। বাস্তবায়নের অভাবে কাজে আসেনি দুটি মহাপরিকল্পনা। বছরে যানজটে আর্থিক ক্ষতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় প্রাপ্ত। অবশ্য আগের বছর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ঢাকায় কর্মব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) গাড়ির গড়গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার। যানজট নিরসনে এক যুগে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হলেও গাড়ির গতি একই সময়ে কমে পাঁচ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ২০২৭ সালে ঢাকায় গাড়ির এই গতি আরও কমে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার হবে।

কতটা বেড়েছে যানজট :বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর 'ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বল। পৃথিবীর ২০৩টি শহরের মধ্যে দ্বিতীয় যানজটপূর্ণ নগর বাংলাদেশের রাজধানী। ২০১৬ সালে এ অবস্থান ছিল তৃতীয়। ২০১৫ সালে ছিল অষ্টম। নামবিওর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গন্তব্যে পৌঁছাতে একজন মানুষের গড়ে ৬১ মিনিট সময় লাগে। ২০১৬ সালে সেটা লাগত ৫৮ মিনিট।

ঢাকার যানজট পরিস্থিতি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। বিশেষ করে রমজান শুরুর পর এ অবস্থার অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল দুর্বিষহ যানজট।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে ধারণার চেয়ে দ্রুত। তার গবেষণার তথ্য, ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয় যানজটে। অথচ এক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য ছিল, দৈনিক অপচয় হয় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। তখন যানজটে বার্ষিক ক্ষতি ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। সেটা বেড়ে এখন হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে গাড়ির গতি আরও কমবে। ঢাকা এক সময় নিশ্চল শহরে পরিণত হবে।

শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, পরিবহন মালিক-চালকরাও বলছেন, গাড়ির গতি কমছে দিন দিন। হিমাচল পরিবহনের মালিক আবু সাঈদ চৌধুরী জানিয়েছেন, একসময় মিরপুর-গুলিস্তান রুটে তারা পাঁচটি ট্রিপ চালিয়েছেন। কিন্তু এখন তিনটিই চালানো যাচ্ছে না যানজটের কারণে। প্রায় সব মালিকের একই দাবি। চালকরাও বলছেন, যানজটের কারণে ট্রিপ কমেছে। আয় কমেছে। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, যানজটের কথা বলে লাভ নেই। পরিবহন ব্যবসায়ীদের মুনাফা দূরে থাক, খরচ তুলে আনাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে এই যানজটের কারণে। তিনি জানান, ট্রিপ কম হলেও বাসের খরচ একই রকম হয়।

মালিক ও চালকরা জানান, যানজটে আয় কমায় বাসগুলো ব্যস্ততম সড়কে বেপরোয়া গতিতে চলে ক্ষতি পোষাতে। মোড় দখল করে যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতায় নামে। এতেও যানজট বেড়েছে। রেষারেষিতে প্রাণ যাচ্ছে যাত্রীর। এ কারণেই সম্প্রতি দুই বাসের ফাঁকে পড়ে হাত হারিয়েছেন কলেজছাত্র রাজীব হাসান।

সাধারণ যাত্রীদের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। কাঁঠালবাগানে থেকে গত সাত বছর প্রতিদিন গুলশানে অফিস করেন সাইফুল ইসলাম। তার অভিজ্ঞতা সাত বছর আগে সকালে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট লাগত কারওয়ান বাজার থেকে গুলশান যেতে। তখন হাতিরঝিল ছিল না। কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট, জাহাঙ্গীরগেট, মহাখালী, আমতলী, টিবি গেট হয়ে গুলশান যেতেন তিনি। এখন হাতিরঝিল হয়ে যান। দূরত্ব কমেছে অর্ধেক। কিন্তু সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা।

কেন বেড়েছে যানজট :যানজট নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণে গত এক দশকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। তারপরও কেন যানজট বেড়েই চলেছে? এ প্রশ্নে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সবার উত্তর, সড়কের স্বল্পতা, দুর্বল গণপরিবহন ব্যবস্থা, মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার, সড়কে অবৈধ দখল-পার্কিং ও পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা যানজটের জন্য দায়ী।

আরও দুটি কারণকে যানজটের জন্য বিশেষভাবে দায়ী করছেন তারা। তা হলো ঢাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ ও সমন্বয়হীনতা। এতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, যানজট নিরসনে নগরীতে দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং পুলিশ কাজ করে, কিন্তু এই চার সংস্থার মধ্যেও সমন্বয় নেই। ঢাকায় কখনও গণপরিবহনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। 'দৃশ্যমান উন্নয়নে'র ভ্রান্ত পরিকল্পনায় একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। সারাবিশ্বে বাস, সাইকেল, হেঁটে চলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশে প্রাধান্য দেওয়া হয় প্রাইভেটকারবান্ধব ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে।

ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনালের ফেলোশিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সড়কের ৭৬ ভাগ থাকে প্রাইভেট গাড়ির দখলে। কিন্তু এসব গাড়ির যাত্রী মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ২৪ ভাগ সড়ক ব্যবহারের সুযোগ ৯৪ ভাগ যাত্রীর। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ এখনও কার্যকর হয়নি। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৭ সালে ঢাকায় দৈনিক গড়ে ৫৩টি প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হয়েছে। একই বছরে প্রতিদিন রাস্তায় নতুন যানবাহন নেমেছে ৩৮৩টি।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ভালো মানের গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। যার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো, তিনিই প্রাইভেট গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন বাসের ঝক্কিঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে।

সমন্বয় ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঘাটতি :সরকারের তরফ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে যানজট কমবে। যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহমেদ বলেছেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে নগর পরিবহন ব্যবস্থা গণপরিবহনবান্ধব হবে। শৃঙ্খলা আনতে বাসের পৃথক করিডোর 'বাসনেট' চালু হচ্ছে। এ পদ্ধতি চালু হলে যাত্রী যত্রতত্র ওঠানামা করবে না। বাসও যত্রতত্র থেমে যাত্রী পেতে প্রতিযোগিতায় নামবে না।

অবশ্য গণপরিবহনবান্ধব ব্যবস্থা গড়ে তোলার এ ঘোষণা নতুন নয়। দুই দশকের পুরনো। ১৯৯৮ সালে প্রণীত ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (ডিইউটিপি) পর ২০০৪ সালে করা হয় কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। কিন্তু এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে ভেস্তে যায়। রাজধানীর যানজট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভা থেকে ২০১৫ সালে ২৯টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক জানিয়েছেন, এসটিপিতে ঢাকায় তিনটি মেট্রোরেল ও বাসের জন্য তিনটি পৃথক লেন (বাস র্যা পিড ট্রানজিট-বিআরটি) নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা না করে ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রাইভেটকারবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এসব কারণে যানজট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এসটিপি বাস্তবায়নে ব্যর্থতায় প্রণয়ন করা হয় সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি), যা ২০১৬ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। ২০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে দুই লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, এ সময়ে ঢাকায় পাঁচটি মেট্রোরেল রুট নির্মাণ করা হবে। এর একটির (এমআরটি-৬) অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলছে। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের প্রথম অংশ ২০২০ সালের শেষ নাগদ চালুর সম্ভাবনা নেই। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ১২ শতাংশ।

আরএসটিপিতে দুটি বিআরটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বিআরটি-৩-এর জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর অংশের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজও ২০২০ সালের আগে শেষ হবে না। ফলে আগামী দুই বছরে গণপরিবহনের জন্য সুখবর নেই। ড. শামছুল হক বলেন, সবচেয়ে সহজে বাস্তবায়ন করা যায় বিআরটি। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয় সামান্য। খরচও হয় অন্যান্য অবকাঠামোর তুলনায় কম। কিন্তু বাংলাদেশে ১৪ বছরেও সেটা করা হয়নি। অথচ ভারত ও ইন্দোনেশিয়া একই সময়ে পরিকল্পনা নিয়ে একের পর এক বিআরটি নির্মাণ করে যানজট নিরসন করেছে।

আরএসটিপিতে মেট্রোরেল ছাড়াও বৃহত্তর ঢাকায় তিনটি বৃত্তাকার সড়ক- তাকে যুক্ত করে নতুন সড়ক ও ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আরএসটিপি অনুমোদনের সময় বলা হয়েছিল, মহাপরিকল্পনায় যা নেই, এমন প্রকল্প ঢাকায় নেওয়া হবে না। কিন্তু গত বছরের এপ্রিলে কাকরাইল থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে ডিটিসিএ। এ ফ্লাইওভার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে নির্মাণ করবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

যে পথে ফ্লাইওভার নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, একই পথে বিআরটি-৩-এর উত্তর অংশ এবং মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পা এক যুগ আগের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গণপরিবহনের সঙ্গে ফ্লাইওভারটি সাংঘর্ষিক। তবে ডিটিসিএ নির্বাহী পরিচালক বলছেন, সরকারের সব সংস্থার মতামত নিয়ে সেটা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বলেছেন, পৃথিবীর কোথাও শহরের ভেতরে ফ্লাইওভারের ওঠানামার র্যা ম্প থাকে না। এতে যানজট এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয় মাত্র। শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কে জায়গা কমে। তিনি হানিফ ফ্লাইওভারের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নিচের রাস্তার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। মানুষ চলতেই পারছে না। মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে যানজট বেড়েছে বাংলামোটর ও তেজগাঁওয়ে।

যানজট মাত্রা ছাড়ালেও শুধু ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে ৬০ শতাংশ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। ড. শামছুল হক বলেছেন, আরএসটিপিতে গণপরিবহনের যে প্রকল্প রয়েছে সেগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

 

http://samakal.com/capital/article/18051358