২২ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪১

বৃষ্টি আরো হবে বন্যার শঙ্কা

পুরো বৈশাখে ছিল প্রকৃতির এলোমেলো আচরণ। যখন আকাশ রৌদ্রোজ্জ্বল থাকার কথা তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে নেমেছে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। কোথাও ভারি বর্ষণ, কোথাও আবার বজ্রপাত। পুরো বৈশাখের খুব কম দিনই ছিল, যেদিন বৃষ্টি হয়নি। রাজধানীসহ সারা দেশে একই চিত্র। বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, বৃষ্টির ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আগামী এক সপ্তাহ সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হবে—এমন আভাস আবহাওয়া অফিসের। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রাক-বর্ষাতেই এত বৃষ্টি, ভর বর্ষা মৌসুমে এবার বৃষ্টিপাত হবে আরো বেশি। ইতিমধ্যেই কয়েকটি জেলায় সাময়িক বন্যা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যারও অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।

বৃষ্টিপাতের কারণে জ্যৈষ্ঠের খরতাপ নেই। তপ্ত রোদে এখন জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার কথা, মাঠ ফেটে চৌচির হওয়ার কথা। এবার তা দেখা যাচ্ছে না। আবহাওয়া অফিসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গতবার ঠিক এই সময়ে (২০ থেকে ২২ মে) ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে তাপমাত্রা গড়ে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। এবার তা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্যৈষ্ঠের এই সময়ে আকাশ থাকার কথা স্বচ্ছ মেঘমুক্ত। কিন্তু এবার ঘটছে তার উল্টোটা। বেশির ভাগ সময়ই আকাশ থাকছে মেঘে ঢাকা। গতকাল সোমবার সারা দিনই মেঘের সঙ্গে সূর্যের ছিল লুকোচুরি। ভোর থেকে টানা বৃষ্টি হয়েছে এক ঘণ্টার বেশি। দিনের অনেক সময় সূর্যের দেখা মেলে না। সকাল-সন্ধ্যায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী। রোদের প্রখরতায় প্রাণ জুড়ানো রসাল ফলের আগমন ঘটে এই সময়ে। কিন্তু রোদের পরিবর্তে এখন চলছে বৃষ্টির দাপট। তথ্য বলছে, নববর্ষের প্রথম দিনই দুপুরের পর থেকে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। রমজানের প্রথম দিনও ঢাকাসহ সারা দেশে হালকা থেকে ভারি বর্ষণ হয়েছে।
টানা বৃষ্টিপাতের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সড়ক, রেল, সেতুসহ সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ কাজের গতি কমে গেছে। দিনমজুরদের চোখে-মুখে অন্ধকার। বৃষ্টির কারণে কাজ কমে গেছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাটের অবস্থা নাজুক। খানাখন্দের কারণে মহাসড়ক ও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট। বৃষ্টির কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে বোরো ফসল। দেশের অনেক স্থানে এখনো বোরো ফসল মাঠে। ফসল ওঠাতে না পারায় কৃষকের চোখে-মুখেও অন্ধকার। মরিচসহ রবিশস্য এখন মাঠে। সেসব ফসলও ক্ষতির মুখে পড়েছে। বৃষ্টির কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে যাওয়ায় চিন্তিত পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কালের কণ্ঠ’র এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় এবার বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টি শেষ হলে প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। আমরা এখন বৃষ্টি বন্ধের অপেক্ষা করছি। এ ছাড়া প্রতিদিনই বজ্রপাত হচ্ছে। এ কারণে কৃষক ভয়ে বোরো ফসল ওঠাতে পারছে না।’

আবহাওয়া অফিসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর গতবারের সঙ্গে তুলনা করলে এবার ১ থেকে ২১ মে পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, যেভাবে বৃষ্টি অব্যাহত আছে, তাতে এবার তাপপ্রবাহ হওয়ার আশঙ্কা একদম ক্ষীণ। চলতি মাসের অবশিষ্ট সময়েও বৃষ্টিপাত হবে। পুরো মাস এভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত ২ জুন থেকে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়। এবার প্রাক-বর্ষা এবং বর্ষা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
জ্যৈষ্ঠে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ একটি স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু এ বছর তা চোখে পড়ছে না। গত বছর এই সময়ে (২০ থেকে ২২ মে) ঢাকা বিভাগে গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ এ বছর ২০ থেকে ২১ মে ঢাকা বিভাগের গড় তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু ৮ মে এক দিন যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য বিভাগগুলোরও একই চিত্র। গতবার এই সময়ে তাপমাত্রা ছিল ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর ঠিক একই সময়ে গড় তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং বাংলাদেশে ভারি বর্ষণের কারণে বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মনু, খোয়াই, ধলাই ও গোমতী নদীর পানি বাড়ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনোয় বেশির ভাগ স্থানেই বৃষ্টিপাত হবে। এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার নদ-নদীর পানি বাড়বে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণে থাকা ৯৪টি স্টেশনের মধ্যে ৩৪টি সমতল স্টেশনের পানি বাড়ছে। ৪৬টি স্টেশনের পানি কমছে।

ওয়ার্ল্ড মেট্রোরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন গত ২০ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরাম’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এবার জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে।
আবহাওয়া কর্মকর্তা আবুল কালাম মল্লিকের মতে, ১ থেকে ২১ মে পর্যন্ত সারা দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা সাত হাজার ২৯০ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টি হয়েছে আট হাজার ৯৯০ মিলিমিটার। আর এই বৃষ্টি শিগগিরই থামছে না। পুরো মাসেই থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। মে মাসে বৃষ্টিটা হয় সাধারণত ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত। তিনি বলেন, এ বছরের প্রকৃতির আচরণ অস্বাভাবিক।
কেন এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত—এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আবহাওয়া বিভাগের সাবেক পরিচালক শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। এই সময়ে তাপপ্রবাহ হওয়ার কথা; কিন্তু তা-ও হচ্ছে না। উল্টো টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ হলো, এবার পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাব অনেক বেশি এবং তা অনেক সময়জুড়ে। পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও তত্সংলগ্ন এলাকায় বিরাজ করছে। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালি বাতাসের সংমিশ্রণের কারণে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হয়। এই গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে।

আবুল কালাম মল্লিকের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তিনি বলেন, এখন চলছে প্রাক-বর্ষা মৌসুম। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে চলে আসবে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আলহাজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, টানা বৃষ্টিতে বোরো ধান ওঠাতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ধান উঠে গেছে। এখনো ২০ শতাংশ ধান মাঠে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে ঢেঁড়স, ধুন্দুলসহ কিছু শাকসবজির ক্ষতি হবে। বৃষ্টি দীর্ঘমেয়াদি হলে ক্ষতি আরো হবে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দিন চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বেশির ভগি জায়গায়, ঢাকা ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া এবং বিদ্যুৎ চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ এবং বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। আগামী তিন দিন এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের মতে, এ বছরটি ‘লা নিনার’ বছর। তাই এবার বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থাগুলোর তথ্যও বলছে, এ বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বৃষ্টি বেশি হবে। মৌসুমি বায়ু এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। তবে মৌসুমি বায়ুর চাপ এবার বেশি। গতবারের মতো এবারও দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হতে পারে। তাই আমাদের এখন থেকে বন্যার আগাম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বিশেষ করে যেসব বাঁধ ঝুঁকিতে আছে, সেগুলো দ্রুত সংস্কার ও বৃষ্টির পানি যত দ্রুত সম্ভব বের করে দেওয়া দরকার।
আইনুন নিশাত বলেন, অন্যবারের তুলনায় এ বছর বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যার কারণে সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জে এরই মধ্যে বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে এসব বন্যা স্বল্পমেয়াদি। ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বর্ষার বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি যখন বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে, তখনই বোঝা যাবে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হবে। এই দুই নদীর পানি এখনে বিপত্সীমার বেশ নিচে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনো, মৌলভীবাজারে বন্যা দেখা দিয়েছে। ওই সব জেলার অনেক স্থানে বন্যার কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এই বন্যা উজান থেকে নেমে আসা পানি ও ভারি বর্ষণের কারণে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলায়ও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। যার কারণে ওই সব জেলার নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার মধ্যে রয়েছে। তবে এই বন্যা স্বল্পমেয়াদি। পানি উঠে আবার নেমে যায়। তিনি বলেন, বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার সময় এখনো আসেনি। জুনের শেষ সপ্তাহে এবং জুলাই এর প্রথম সপ্তাহ থেকে বড় বন্যা আসতে পারে। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বন্যা হতে পারে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/05/22/639022