২২ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩০

খাল পুনঃখননে ব্যয় নদী ড্রেজিংয়ের চেয়েও বেশি

নদী ড্রেজিং বা খাল পুনঃখনন প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। খাল খননের নামে এক ধরনের লুটপাটের আয়োজন হচ্ছে। যেখানে যমুনার মতো বড় নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি টাকা, গড়াই, ইছামতি ও কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ১৩ কোটি টাকার উপরে সেখানে ঢাকার খাল পুনঃখননে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অথচ রাজধানীর চলমান পাঁচটি খাল খনন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ৯২ লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ধারণার ওপর ভিত্তি করেই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। যার কারণে ব্যয় বেশি হয়। পরে যখন পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পেশ করা হয় তখন তারা ব্যয় কমানোর সুপারিশ করে। নদী ড্রেজিং আর খাল খননের ব্যয়ে অবশ্যই ফারাক হবে। তবে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ ধরনের প্রকল্প মানেই লুটপাটের আয়োজন। যে ধরনের ব্যয় এসব প্রকল্পে ধরা হয়েছে তা লুটপাট ছাড়া কিছুই না।

প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ঢাকার ১৩টি স্থানের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খাল খননসহ পানি নিষ্কাশন সংক্রান্ত দ্বিতীয় একটি প্রকল্প ঢাকা ওয়াসা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। কয়েক দফা ফেরত ও একবার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রত্যাহারের পর আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পেশ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও খাল উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ দশমিক ০৬৭ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন ও উন্নয়ন করা হবে। এলাকাগুলো হলো ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, শঙ্কর, জিকাতলা, রায়েরবাগ, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, দারুস সালাম, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা ও বিমানবন্দর থানা। প্রকল্পের কাজের মধ্যে রয়েছে, ৮ দশমিক ২১১ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ারেজ নির্মাণ, ৭ দশমিক ১৩ কিলোমিটার সড়ক খনন ও মেরামত, খাল রক্ষণাবেক্ষণ ১১ দশমিক ৩৩৯ কিলোমিটার, ১.১০ কিলোমিটার ইউটাইপ চ্যানেল নির্মাণ, কালভার্ট, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, আরসিসি পাইপ ক্রয় ইত্যাদি।

ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০ দশমিক ০৬৭ কিলোমিটার খাল পুণঃখনন ও উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮৯ কোটি ৩১ লাখ ২২ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৪ কোটি ৪১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। যেখানে যমুনা নদীতে প্রতি কিলোমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি টাকা, গড়াইতে ১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা, সেখানে ইছামতি ও কর্ণফুলীর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এখানে যমুনার চেয়ে ৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং অন্য নদীর চেয়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকা বেশি ব্যয় হবে এ খান পুনঃখননে। ইছামতি ও কর্ণফুলী নদীর ১৯ কিলোমিটার পথ ড্রেজিংয়ে ব্যয় হবে ২৫৪ কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অন্য দিকে হাজারীবাগ, বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খালে ভূমি অধিগ্রহণ এবং খনন বা পুনঃখনন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার খাল পুনঃখননে ব্যয় ধরা হয় তিন কোটি ৯২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের জন্য ব্যয় হবে ৫২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ফলে এ প্রকল্পের চেয়েও প্রস্তাবিত প্রকল্পে খনন ব্যয় প্রতি কিলোমিটার সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেশি।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ১৯৮৯ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কাছ থেকে ঢাকা ওয়াসাতে ন্যস্ত করা হয়। ঢাকা মহানগরীতে ৪৪টি খাল, ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও বিভিন্ন সংস্থার কয়েক হাজার কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে ড্রেনেজব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। যেকোনো স্থানের ড্রেনেজ ব্যবস্থার প্রাইমারি অবকাঠামো হচ্ছে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা নতুন সৃষ্ট খাল, যার মাধ্যমে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়ে নদ-নদীতে নিষ্কাশিত হয়। রাজধানীতে ৪৩টি প্রাকৃতিক খাল বিদ্যমান রয়েছে, যার মধ্যে ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন খালের সংখ্যা ২৬টি। এ খালগুলোর স্থায়ী অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। বর্তমানে মহানগরীতে ১৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৪৪টি খাল রয়েছে। নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার কিছু খাল বর্তমানে ব্যক্তিগত জমির মাধ্যমেও প্রবাহিত হচ্ছে। যেখানে ঢাকা ওয়াসার আইনগত কোনো কর্তৃত্ব নেই। এতে করে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকেরা যেকোনো সময় তাদের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নগরীর সুষ্ঠু ড্রেনেজ-ব্যবস্থা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে ওয়াসা মনে করছে।

ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়নের মাধ্যমে উল্লিখিত এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত খালগুলো খনন ও প্রশস্ত করে তীর উন্নয়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে খালের দুই তীরের পরিবেশ উন্নত করা হবে।
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড. জায়েদ বখতের মতো, নদী ড্রেজিং আর খাল খননের ব্যয়ে অবশ্যই ফারাক হবে। প্রতি কিলোমিটার ব্যয় নদীর সাথে খালের ব্যয় অবশ্যই বড় ব্যবধান থাকবে। তবে এ প্রকল্পের কেন এত বেশি তা বলাটা মুশকিল। আমাদের দেশে প্রকল্প প্রণয়নের আগে সমীক্ষা করার সংখ্যা কম। ধারণার ওপর ভিত্তি করেই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। যার কারণে ব্যয় বেশি হয়। পরে যখন পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পেশ করা হয় তখন তারা ব্যয় কমানোর সুপারিশ করে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মতে, এ ধরনের উদ্যোগকে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ ধরনের প্রকল্প মানেই লুটপাটের আয়োজন। যে ধরনের ব্যয় এসব প্রকল্পে ধরা হয়েছে তা লুটপাট ছাড়া কিছুই না। নির্বাচনের আগে সরকার যত তাড়াতাড়ি সব এসব প্রকল্পকে অনুমোদন দিচ্ছে। এগুলোর কাজও ঠিকমতো হবে না। হবে শুধু জনগণের করের টাকার অপচয়। এখানে গরু মেরে জুতা দান করার মতো অবস্থা। তিনি বলেন, এক কিলোমিটার খাল খননে এত টাকার প্রশ্নই আসে না। ঢাকা শহরে ভাসমান যেসব মানুষ আছে সরকার এদের খাল খনন কাজে লাগাতে পারত। এতে করে এসব মানুষ কাজ পেত। আর প্রকল্পের কাজের ব্যয়ও অনেক কম হতো।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/10982