বিনামূল্যের বই অনিশ্চিত
২২ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৫

বিনামূল্যের বই অনিশ্চিত

এনসিটিবির সিদ্ধান্তহীনতা

সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিকের ১১ কোটি বইয়ে টেন্ডার জটিলতায় অবশেষে পুনঃটেন্ডারের পথেই সমাধান খুঁজছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পুনঃটেন্ডারের কথা শোনা যাচ্ছে, প্রাক-প্রাথমিকের বইয়েও। পুনঃটেন্ডারের ফলে প্রাথমিকের বই আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আগামী ২১ জুনের মধ্যে পুনঃটেন্ডার দাখিল করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিকে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশ দেয়ার কথা থাকলেও গতকাল সোমবার থেকে শোনা যাচ্ছে, কাগজের ব্রাইটনেস কমে যাওয়ায় এ বই ছাপার কাজেও পুনঃটেন্ডার হতে পারে।

শুধু প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিকের বই নয়, একই অবস্থা মাধ্যমিক, ইবতেদায়ি ও দাখিল এবং উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ের ক্ষেত্রেও। অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও কর্তাব্যক্তিরা। উচ্চ মাধ্যমিকের আবশ্যকীয় তিনটি বই ছাপার আদেশ দিতেও গড়িমসি করছে এনসিটিবি। এ নিয়ে মুদ্রণকারীদের সাথে একটি সমঝোতা বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এনসিটিবির সাথে সমঝোতা বৈঠকে যেতে মুদ্রণকারীরা আগ্রহী নয় বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষ এক মুদ্রণকারী নয়া দিগন্তকে জানান। তিনি অভিযোগ করেন, এনসিটিবির কথা ও কাজে মিল থাকছে না। তাই অনেকেই সমঝোতা বৈঠকে যাননি। আগামী ১ জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণীর কাস শুরু হবে। বাংলা ও সহপাঠ বইয়ের দাম বাড়ানো হয়। ইংরেজি বইয়ের দাম গত বছরের মতোই রাখা হয়। কাগজসহ মুদ্রণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বইয়ের দাম বাড়ানোর দাবিতে উচ্চমাধ্যমিকের বই ছাপার জন্য এনসিটিবির ৯৩টি টেন্ডার বিক্রি হলেও, মুদ্রণকারীদের কেউই তাতে অংশ নেয়নি। ফলে নতুন বই ছাড়াই কাসে বসতে হবে একাদশের নতুন শিক্ষার্থীদের। এখন উচ্চমাধ্যমিকের এ তিনটি বই নকলের আশঙ্কা করছেন মুদ্রণকারীরা। সত্যিই তাহলে এনসিটিবি বড় ধরনের রাজস্ব আয় ও রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হবে।

বছরের সাড়ে চার মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে। গতকাল পর্যন্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ি ও দাখিল এবং উচ্চমাধ্যমিক কোনো স্তরের (প্রায় ৩৭ কোটির বেশি) বই ছাপার জন্য একটি টেন্ডারেরও নিষ্পত্তি হয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো স্তরের বইয়ের টেন্ডারের কার্যাদেশ দিতে পারেনি এনসিটিবি। গত ২৮ মার্চ মাধ্যমিকের সুখপাঠ্য, ব্যাকরণ, গণিত, বাংলা, ইংরেজিসহ আরো কিছু বইয়ের টেন্ডার আহ্বান করা হলেও গতকাল পর্যন্ত এসব বইয়ের কার্যাদেশ দেয়া যায়নি। বইগুলো ছাপার জন্য এনসিটিবি কাগজ সরবরাহ করে থাকে। এ কাগজ এনসিটিবির গুদামে গতকাল পর্যন্ত মজুদ থাকার পরও কার্যাদেশে দেরি হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের অন্য বই ছাপার কাগজের বর্তমান বাজার মূল্য নিয়ে জটিলতা ও দর কষাকষি চলছে কিন্তু যেসব বই নিয়ে এনসিটিবি ও মুদ্রণশিল্প মালিকদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই সেগুলোরও কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে না। অপর দিকে, গত ৭ মে মাধ্যমিকের আরো কিছু পাঠ্যবই ছাপার কাগজের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে চলমান জটিলতায় এ টেন্ডারও বাতিল করে পুনঃটেন্ডার করা হবে বলে গুঞ্জন চলছে। উচ্চমাধ্যমিকের (একাদশ শ্রেণির) তিনটি বই ছাপা হবে কি না, তা নিয়ে দোটানায় পড়েছে এনসিটিবি। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তও নেয়া হচ্ছে না। ফলে আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০১৯) প্রাথমিক ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক ও দাখিল এবং কারিগরি স্তরের বই সময়মতো শিক্ষার্থীরা পাবে কি না সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ দ্রুত টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্যাদেশ দেয়া হলেও ডিসেম্বরে বিনামূল্যের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো যাবে না বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ নির্বাচনী ডামাডোলের বছর বিবেচনায় ডিসেম্বরের আগেই বিদ্যালয়ে বিনামূল্যের পাঠ্য বইয়ের চালান পৌঁছাতে চাইছে সরকার।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্টরা নয়া দিগন্তকে বলেন, এনসিটিবির শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কালো তালিকভুক্ত ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে চেয়ারম্যানের রুদ্ধদ্বার বৈঠক : এ দিকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল দুপুরের কিছু পরে ভারতীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ‘প্রিতাম্বার’র একটি প্রতিনিধিদলের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তার অফিস কক্ষে। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পায়। কিন্তু সরবরাহ করেছিল নির্ধারিত সময়ের চার মাস পর। ফলে এনসিটিবি এ প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিতর্কিত এ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এরা গত দুই বছর এনসিটিবির টেন্ডারে অংশ নিতে পারেনি। এবার প্রাথমিকে বইয়ের পুনঃটেন্ডার হওয়ায় তাতে অংশ নেয়ার পাঁয়তারা করছে বলে দেশীয় মুদ্রণকারীদের অভিযোগ। রুদ্ধদ্বার বৈঠক তারই অংশ। তবে এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আড়াই মাস পেছাতে পারে প্রক্রিয়া : পুনঃটেন্ডারের ফলে শিক্ষার্থীরা বই পেতে কমপে দুই মাস পিছিয়ে পড়বে। শর্তানুসারে টেন্ডার দাখিলের জন্য ৪২ দিন সময় দিতে হবে। এ ছাড়া মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশ দিতে আরো প্রায় এক মাস সময় লেগে যাবে। তাই আড়াই মাস পিছিয়ে পড়বে বই মুদ্রণ ও সরবরাহের কার্যক্রম। প্রাক-প্রাথমিকের বইয়েও যদি পুনঃটেন্ডার করা হয় তাহলে এখন থেকে আরো ৪২ দিনে পিছিয়ে যাবে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত সময়ে বই সরবরাহে বিঘœ ঘটায় বা পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকারও করেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও চাহিদা মতো অক্টোবরের মধ্যে আমরা এবারের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও সরবরাহের কাজ শেষ করতে চাই। নতুন টেন্ডারের কারণে হয়তো বই সরবরাহ নভেম্বর পর্যন্ত যেতে পারে। তবে আমরা টার্গেট ঠিক রেখেই কাজ করে যাচ্ছি। বড় ধরনের সমস্যার আশঙ্কা করছি না।

বিকল্প ভাবনায় কারো সায় নেই : আর মাত্র ৩৯ দিন পর (১ জুলাই) শুরু হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের কাস। বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখার সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক। এ বই তিনটি বিনামূল্যে দেয়া না হলেও এনসিটিবির নির্ধারিত বই বাধ্যতামূলক। এ তিনটি বই এনসিটিবি নিজে ছাপায় না। মুদ্রণকারীদের কাছে স্বত্ব দেয়া হয় এবং বইয়ের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা রয়্যালিটি বা রাজস্ব আদায় করে এনসিটিবি। কিন্তু এ বছর বই তিনটি নিয়ে গতকাল পর্যন্ত সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। টেন্ডারের শিডিউল কেনার পরও কাগজ ও মুদ্রণ-সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজার মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে দাম নির্ধারণ না হওয়ায় কেউ টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে বই তিনটি নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। এখন ‘অফারিং সিস্টেমে’ কাজটি দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এ জন্য মুদ্রণশিল্প মালিকদের সাথে সমঝোতা বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয় এনসিটিবি। গতকাল এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো বৈঠকে মুদ্রণশিল্প মালিকদের পক্ষে কেউ অংশ নেয়নি বলে জানা গেছে। ফলে এনসিটিবির এ উদ্যোগও ব্যর্থ হওয়ার পথে। এ অবস্থায় উচ্চমাধ্যমিকের বই তিনটি এবার নকল হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাহলে এনসিটিবি এ বছর কয়েক কোটি টাকার রয়্যালটি হারাবে।
ওয়েব আর অফসেট মেশিন মালিকদের দ্বন্দ্ব : বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার জন্য দেশীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে কয়েক বছর থেকেই চলছে দ্বন্দ্ব। অর্ধশতাধিক ছাপা প্রতিষ্ঠানের মালিকের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ১৬৫টি ওয়েব মেশিন। চলতি বছর ৬৬টি ওয়েব মেশিন প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর অতিরিক্ত আরো ১৩টি ওয়েব মেশিন এতে যুক্ত হচ্ছে। এসব মেশিনে বই ছাপা-বাঁধাই ও প্যাকেটজাত হয়ে বের হয়। অল্প সময়ে অধিক বই ছাপা যায়।

অপর দিকে আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে এক হাজারের অধিক অফসেট প্রিন্টিং প্রেস। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রেস পাঠ্যবই ছাপার কাজে অংশ নেয়। এ দু-গ্রুপের মধ্যে গত কয়েক বছর থেকে চলছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। অফসেট প্রিন্টিং প্রেস মালিকেরা বলছেন, ওয়েব মেশিন মালিকেরা সিন্ডিকেট গড়ে এনসিটিবির মাধ্যমে বইয়ের বড় লট তৈরি করে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে বড় লটের কাজ ভাগ-বাটোয়ারা করে। এদের ছাপার মান ভালো নয়। বই সময়মতো সরবরাহ করতে পারে না। কয়েক বছর তারাই (ওয়েব মালিকেরা) বই দিতে দেরি করেছেন।
অপর দিকে, ওয়েব মেশিন মালিকেরা বলছেন, অফসেট মালিকদের কারণেই বই ছাপার কাজ ভারতীয় মুদ্রণকারীরা নিয়ে গেছে। তারা ওয়েব মেশিনে বই ছাপিয়ে দ্রুত ও সময়ের আগেই বই সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করে নয়া দিগন্তকে বলেন, এ বছর প্রায় ৩৭ কোটি বই অফসেট প্রিন্টিং প্রেসে সারা বছর ছাপিয়েও সময়মতো সরবরাহ করা কঠিন হবে। এ কারণেই এনসিটিবি বই ছাপার কাজ বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চায়। দেশাত্মবোধের চেতনা থেকেই মুদ্রণশিল্প মালিকেরা অত্যাধুনিক ওয়েব মেশিন দেশে নিয়ে এসেছেন। টেন্ডারের শর্ত ও শিডিউল মতো বই সরবরাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না গত দুই বছর থেকে। তিনি বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মুদ্রণশিল্পকে অবশ্যই আধুনিক করতে হবে। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

http://www.dailynayadiganta.com/education/11060