২১ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:২১

সীমান্তে ফের ‘উস্কানি’ মিয়ানমারের

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্তের কোনাপাড়ার শূন্য রেখায় (নো-ম্যানস ল্যান্ড) থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে সরে আসতে ফের মাইকিং করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
১৯ মে শনিবার সকাল থেকে তারা এ মাইকিং শুরু করে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এই ঘটনায় সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছে বিজিবি।

মিয়ানমারের সেনাদের এই পদেক্ষেপে সীমান্তে থাকা রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে উদ্বিগ্ন সীমান্তের বাংলদেশিরাও। রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘শনিবার সকাল থেকে মাইকিং করে মিয়ানমারের সেনারা বলছেন এটি মিয়ানমারের সীমানা। এখান থেকে সরে বাংলাদেশে চলে যাও।’ ‘কিছুক্ষণ পরপর তারা এ কথা বলছে। এর আগেও তারা একইভাবে মাইকিং করছিল।’
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘এর আগেও তারা একবার মাইকিং করে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের দিকে সরে আসতে বলেছিল। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবার মাইকিং করে একই কথা বলছে। এরপর থেকে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আতঙ্ক বিরাজ করছে।’ তুমব্রু সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে এখন প্রায় চার হাজারের মত রোহিঙ্গা রয়েছে।

তুমব্রু বিওপি কমান্ডার সুবেদার আব্দুল হাকিম জানান, আমরা শুনেছি- সকাল থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসতে থেমে থেমে মাইকিং করছে এবং বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে।
তবে আমাদের পক্ষ থেকে আগের চেয়ে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি তৎপর রয়েছে।
গত মার্চেও এই সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন এবং রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় মাইকিং নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিও শক্তিবৃদ্ধি করেছিল।

বিজিবির তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের পরে অবশ্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী পিছু হটে। দুই পক্ষে পতাকা বৈঠকের পর সরিয়ে নেয়া হয় মিয়ানমারের অস্ত্রশস্ত্র।
মিয়ানমার তার দেশের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে চায় না। নানা সময় সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
সব শেষ গত আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। আর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি চুক্তি করেছে মিয়ানমার।

গত জানুয়ারি থেকেই প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। আর এই প্রত্যাবাসনে সবার আগে নিজ দেশে ফেরার কথা ছিল তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের।
সব শেষ গত ১৭ মে ঢাকায় ঢাকায় বাংলাদেশে-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব এ কে এম শহিদুল হক জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে।
প্রসঙ্গত, তমব্রু সীমান্তে আশ্রয় নেয়া সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে এখন প্রায় ৪ হাজারের মত রোহিঙ্গা রয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের সরে যেতে এর আগে ১ মার্চ মাইকিং করেছিলো মিয়ানমার বর্ডার পুলিশ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে
পাহাড় ধ্বসে ৬ রোহিঙ্গা শিশু আহত
মায়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা লোকজন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিলেও পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। বাড়ছে হতাহতের ঘটনাও। বন্য হাতির আক্রমণ, চলমান বর্ষা মৌসুমে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড় ধ্বস ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হতাহতের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গত ১৯ মে শনিবার উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তিতে পাহাড় ধ্বসে ৬ শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে এ ঘটনাটি ঘটেছে। আহত শিশুরা হলো, বালুখালী-১ রোহিঙ্গা বস্তির ২৭ নং ব্লকের ছৈয়দ আলমের ৩ মেয়ে রোকিয়া বিবি(১১), খালেদা বিবি(৯), সাদিয়া বিবি(৭) ও পার্শ্ববর্তী ৬৩ নং ব্লকের ১ নং সেডের মো. মোছা খলিলের ৩ মেয়ে জান্নাত আরা (১২), রোকিয়া বেগম (১০) ও শওকত আরা বেগম (৬)। আহত এসব শিশুকে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন এম এস এফ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক আহত শিশুরা এখনো শংকামুক্ত নয় বলে জানান। এ ব্যাপারে উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এলক্ষ্যে, গত ১৯ মে শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় উখিয়ার বালুখালী ২/২ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দূর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি মহড়ার আয়োজন করা হয়। মহড়া উদ্বোধনকালে উপস্থিত ছিলেন ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব এস এম শাহ কামাল। তিনি বলেছেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড় ধ্বস ও পাহাড়ী ঢলের আশংকায় ঝূঁকি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্থানীয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিসহ সশস্ত্র ও সরকারি বিভিন্ন বাহিনী এবং বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম শাহ কামাল বলেছেন, আগামী ২ মাসের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে সরিয়ে নেয়া হবে। তিনি বলেছেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ১ লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে ৩২ হাজার পরিবার প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার পরিবারকে ক্যাম্পের অন্য নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের পর খালি জায়গায় নতুন করে বনায়ন করে আগের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে বলেও জানান তিনি।

মহড়ায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় রোহিঙ্গারা মহড়ায় অংশগ্রহণ করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, সেনাবাহিনীর কক্সবাজারস্থ ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ত্রাণও দূর্যো ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম শাহ কামাল ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনসহ প্রশাসন, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নিকারুজ্জামান চৌধুরী, উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল খায়ের ও বিভিন্ন সংস্থার উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা।
এদিকে, অভাব-অনটনের সংসার, জনবহুল বস্তি, শিক্ষার অভাবগ্রস্ত এলাকা ও দূরবর্তী লোকালয়ে সচরাচর অপরাধমূলক কর্মকা- বেশি সংঘটিত হয়। কার্যত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মত প্রতিটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কিন্তু তুলনামূলকভাবে জনবহুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুব কমই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। উপরন্তু প্রশাসনের নানা উদ্যোগে অপরাধের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় সচেতন মহল।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, পূর্বের তুলনায় এখন শান্তিতে বসবাস করছে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়রা। সীমান্ত নিরাপত্তায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো পরিস্থিতির উন্নতি করছে। এ পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানাগেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ আশে-পাশের এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রসস্ত সড়ক নির্মাণ, সোলার লাইট ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে প্রশাসন। ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে সোলার লাইট লাগানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্য রেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে লাগানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। চলছে সড়ক নির্মাণের কাজও।

এছাড়া প্রতিটি ক্যাম্পে পুলিশের কড়া নজরদারি, সন্দেহভাজনদের ক্যাম্প এলাকায় প্রবেশে বাঁধা, সন্ধ্যার পর এনজিও কর্মী ও বহিরাগতদের ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা, ক্যাম্পের শৃংখলা রক্ষার্থে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম, বিজিবি’র সীমান্তে অতন্দ্র পাহারার কারণেই অপরাধ কমেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের।

ঘুমধুম কোনারপাড়া সীমান্তের আশপাশে সিসি ক্যামেরা এবং সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করায় শূন্য রেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা এখন নিরাপদ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারছে। বার্মার সেনা-বিজিবি এবং সশস্ত্র রাখাইন যুবকদের অত্যাচার শতভাগ কমে গেছে। রাতের বেলায় সোলার লাইটের আলোয় আলোকিত হওয়ার কারণে তারা শূণ্য রেখায় আগের মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ড করতে পারছেনা।

http://www.dailysangram.com/post/331209