২১ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:২০

বেড়েই চলেছে বাণিজ্য ঘাটতি॥ ঊর্ধ্বমুখী ডলারের দাম॥ কমছে রিজার্ভ

দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাণিজ্য ঘাটতি অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ফলে ডলারের দামও বেড়ে গেছে। গত দশ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ দুই বিলিয়ন। এমতাবস্থায় কমে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ। রেকর্ড ৩৩বিলিয়নের রিজার্ভ এখন ৩১ বিলিয়নে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা রিজার্ভ কমায় চিন্তার কিছু নেই জানালেও আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩২০ কোটি ২০ লাখ ডলার। আমদানির চাপে ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ পরিমাণ অনেক বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর পুরো অর্থ বছরের (জুলাই-জুন) ঘাটতির চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর অর্থবছর শেষ হয়েছিল এক হাজার ১৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঘাটতি নিয়ে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৪৭ কোটি ডলার আর এ বাণিজ্য ঘাটতি গত ছয় অর্থবছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর সেটাই ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি।

অর্থনীতির গতিধারা অনুযায়ি আমদানি ব্যয় বাড়লে রপ্তানি আয়ও বাড়ে। কারণ বিদেশ থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি করা হয় তার একটি অংশ প্রক্রিয়াজাতকরনের মাধ্যমে রপ্তানি হয়। অতীতে এমন হয়ে আসলেও এবার ব্যাতিক্রম। আশংকা করা হচ্ছে আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। আমদানি ব্যয় দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় দেশের অর্থ পাঁচার হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। তারা বলছেন, প্রকৃত আমদানি বাড়লে অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা নেই। কিন্তু আমদানির নামে অর্থ পাচার হলে তার ফল হবে নেতিবাচক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা উন্নয়ন সহযোগীরা বলছেন, তার মধ্যে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া অন্যতম। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এ কারণে আমদাদিনর পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি আয় না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে।

এ বিষয়ে সিপিডি গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য হচ্ছে না। আমদানির ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতির বাইরে পেট্রোলিয়াম, খাদ্য পণ্য প্রভৃতি অনেক বেশি আমদানি হচ্ছে। বিনিয়োগেও শ্লথ অবস্থা দেখা যাচ্ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেভাবে মূল্য পতন হচ্ছে আমদানির ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আমদানি-রপ্তানির নামে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট পাঁচ হাজার ৫৯৫ কোটি ৭৩ লাখ (৫৫.৯৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। এই ৯ মাসে এলসি নিষ্পত্তি (সেটেলমেন্ট) হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এই ৯ মাসে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৪ হাজার ৩০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৭০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩২০ কোটি ২০ লাখ ডলার।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। এ সময়ে ২২৫ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

আমদানির চাপে বাংলাদেশ বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যেও বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে। লেনদেন ভারসাম্যে এ ঘাটতির পরিমান ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭০৮ কোটি ৩০ লাখ ডলারে। ৯ মাসের এই ঘাটতি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ গুণেরও বেশি। আর পুরো অর্থবছরের ঘাটতির চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল ১৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থবছর শেষে তা দাঁড়ায় ১৪৮ কোটি ডলারে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের ন্যায় গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও কাক্সিক্ষত গতি আসেনি। আর এ ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নিতে হবে।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতি মাসেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এ ধারা অব্যহত থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সব সময়ই আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। গত অর্থবছরে সেটি বেড়ে গেছে। এতে করে আমাদের বহিঃখাত কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ জন্য বৈদেশিক মুদ্রার দর বেড়েছে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। তিনি বলেন, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্সকে অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের যোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় চার টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গ্রাহক পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা ৭০ পয়সায়। রেমিট্যান্স আরো কমলে ডলারের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে টাকার অবমূল্যায়ন আরো বাড়বে। এতে রপ্তানি আয়ের ওপর চাপ পড়বে আরো বেশি।

আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা এবং দর বাড়তির দিকে। গত দশ মাসে ২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর কাছে ৮৩ টাকা দরে ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবমিলিয়ে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দশ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ৩ মে পর্যন্ত) ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করে বা কেনে তাকে আন্ত:ব্যাংক মুদ্রাবাজার বলে। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে কিছু বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়ে গেছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে রিজার্ভের পরিমাণ। আমদানি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় চাপের মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৩৬ কোটি ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল ১৪০ কোটি ডলার পরিশোধ করায় এক হাজার ১৭২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে রিজার্ভ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৩৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমদানি বাড়ছে। বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সামনের দিনগুলোতে সার্বিক রিজার্ভ পরিস্থিতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অনুকূল থাকবে বলেই আশা করছি।

http://www.dailysangram.com/post/331175