২০ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:১২

আবারো বন্দুকযুদ্ধ

যশোরের অভয়নগরে ৩ ও নান্দাইলে ১ জন নিহত

রাজধানীসহ সারাদেশেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহতের ঘটনা ঘটছে। যশোরের অভয়নগরে গত শুক্রবার দিবগত রাতে র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিন জন নিহত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে দাবী আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে পরিবারের অভিযোগ, তাদের র্যা ব পরিচয়ে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় একই সময়ে ময়মনসিংহের নান্দাইলে বন্দুকযুদ্ধে মো. ইমন (১৯) নামে একজন নিহত হয়েছে। র্যা বের দাবি সে একটি হত্যা মামলার আসামী। গত চার দিনে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে নিহত হয়েছেন ৬জন। গত ১৭ মে রাতে চট্টগ্রামের বরিশাল কলোনিতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় দুই জন। নিহতরা মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে র্যা ব।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত মনে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্রসফায়ার দিয়ে একটি প্রতিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। সাধারণ মানুষের জীবনরক্ষার্থে ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিমূলে প্রাণহানি হয়তো হচ্ছে। তবে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে এটি একমাত্র স্থায়ী উপায় হতে পারে না। সাময়ীক এর সুফল পাওয়া গেলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ করা না হলে মানুষ তার আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

আ্ইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে ৫২টি বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫৮ জন নিহত হয়েছে।
গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, র্যা ব মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান করছে। তাদের অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। এ জন্য আমরা আসল অপরাধীদের বিষয়ে জানতে পারলাম না। এ অভিযানকে কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমন ঘটনায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করে থাকেন। এগুলোর বিষয়ে তদন্ত চলছে। বিনা বিচারে কিছু হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। মাদক ব্যবসা যারা করে, তারা তো ভয়ংকর লোক। সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি গোলাগুলিতে কেউ মারা যায়, সেটা ঠিক আছে। তাদের আইনের আওতায় এনেই নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে।
এন্টি টেররিজম ইউনিট প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে ৭৫ লাখের অধিক মাদকাসক্ত। সারাদেশে মাদকের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেছে ব্যবসায়ীরা। মাদক ব্যবসায়ীদের রয়েছে ভাড়াটে অবৈধ অস্ত্রধারী। ফলে পুলিশ বা র্যা ব যখনই মাদক ব্যবসায়ী বা পেশাদার সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে অভিযান চালায় তখন বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, দেশে মাদক এখন ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। সামাজের কিশোর থেকে শুরু করে নানা বয়সের ও পেশার লোকজন মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এখনই মাদক নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব না হলেও আগামী প্রজম্মের একটা বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে। এ জন্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর আইনের প্রয়োগ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। একই সাথে সমাজের সকলকে সচেতন হলে মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধ কমে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

র্যা বের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাদক ব্যবসায়ী ও পেশাদার অপরাধীদের বিরুদ্ধে র্যা ব সারাদেশেই সক্রিয় রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা কখনোই অস্ত্র ছাড়া থাকে না। র্যা ব যখন তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালায় তখন অবৈধঅস্ত্রধারীরা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। তখন র্যা বও গুলি করে। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহত হয়। তিনি বলেন, র্যা ব গত ১০ দিনে মাদক ব্যবসায়ীসহ ২ হাজারের অধিক অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। সব অভিযানে গুলির ঘটনা ঘটেনা। র্যা ব জান-মাল রক্ষায় গুলি করতে বাধ্য হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সূত্র জানায়, চলতি মাসে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, র্যা ব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গত সোমবার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নেয়ার আভাস দেন র্যা বের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজি বেনজীর আহমেদ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যা বের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মাদক প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থায় যত কাঠামো আছে, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবে র্যা ব। কারও কাছে মাদক থাকলে তা র্যা বের ক্যাম্পের পাশে ফেলে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। এর আগে ৩ মে র্যা বের ১৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে র্যা বকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আবদুল আলীম (৫০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। র্যা বের দাবি, নিহত ব্যক্তি একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এ নিয়ে গত চার দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে যে ছয়জন নিহত হয়েছে, তাঁদের ৫জনকেই মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করছে র্যা ব। এর আগে সোমবার রাতে র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় দুই ব্যক্তি, বুধবার রাজশাহীতে এক ব্যক্তি ও বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরে আরও দুই ব্যক্তি নিহত হন।

রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা ও গুলশান এলাকায় ডিস ব্যবসার চাঁদাবাজি ও আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন ডিস ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বাবু ওরফে ডিশ বাবু (৩০)। গত ৯ মে বুধবার রাতে হত্যকান্ডের পর থানা ও ডিবি পুলিশ ওই এলাকায় যৌথ অভিযান চালিয়ে ৩জনকে আটক করে। পরে ১০ মে ভোর ৫টার দিকে ডিবি পুলিশের সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে তানভীর সাফায়েত হোসেন তামরিন ওরফে রানা (৩০) নামে এক যুবক নিহত হয়। গত ১৮ মে শুক্রবার রাত ২টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে উপজেলার ৪নং বেড়িবাঁধ তাঁতিপাড়া এলাকায় র্যা বের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছেন। র্যা বের দাবি, নিহত ব্যক্তি একজন মাদক ব্যবসায়ী। তবে তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
যশোরের বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৩
যশোর ব্যুরো জানান, যশোরের অভয়নগর উপজেলায় র্যা বের সঙ্গে গত শুক্রবার রাতে বন্দুকযুদ্ধে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। র্যা বের দাবি নিহতরা মাদক ব্যবসায়ী। র্যা ব-৬ খুলনা ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. কর্নেল জাহিদ বলেছেন, বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি পালসার মোটরসাইকেল, ২পিস্তল, ৫০০ বোতল ফেনসিডিল, ১টি চাইনিজ কুড়াল ও গুলি ভর্তি একটি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতরা হলেন, অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের কাদের আলী মোড়লের ছেলে আবুল কালাম (৪৭), একই গ্রামের আব্দুল বারিক শেখের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩৮) এবং আব্দুস সাত্তার কাসারীর ছেলে মিলন কাসারী (৪০)।

র্যা ব-৬ জানায়, রমজান মাস উপলক্ষে এবং মাদক চোরাচালানরোধে নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে শুক্রবার রাত নয়টার দিকে র্যা বের একটি টিম পায়রা-নওয়াপাড়া রোডে চেকপোস্ট বসায়। রাত আড়াইটার দিকে তারা যখন একটি মোটরসাইকেল থামিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, তখন আরেকটি মোটরসাইকেলে এসে তিন ব্যক্তি র্যা বকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যা বও পাল্টা জবাব দেয়। এতে র্যা বের দুই সদস্য আহত হন ও মোটরসাইকেলে থাকা ৩জন গুলিবিদ্ধ হন। আহতদের উদ্ধার করে র্যা বের গাড়িতে করেই স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে হাসপাতালে খবর নিয়ে জানতে পারি, তারা মারা গেছে। নিহতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান লে. কর্নেল জাহিদ। অভয়নগর থানার ওসি শেখ গনি মিয়া বলেন, গতকাল সকালে র্যা ব তিনটি লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। দুপুরে মনাতদন্তের জন্য এগুলো যশোর জেনারেল হাসাপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নান্দাইলে বন্দুকযুদ্ধে যুবক খুন
ময়মনসিংহ ব্যুরো জানান, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে যুবক নিহত হয়েছে। নিহতের নাম মো. ইমন মিয়া (১৯)। গত শুক্রবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে নান্দাইল চৌরাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ডিবি পুলিশের দাবি করেছে, নিহত ইমন অটোরিকশা চালক রানা (১৫) হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি আশিকুর রহমান জানান, গত ১৭ মে নান্দাইল উপজেলার বড়াইল এলাকার অটোরিকশা চালক রানাকে (১৫) হত্যা করে অটোরিকশা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরদিন ১৮ মে এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হলে এ হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি মো. ইমনকে (১৯) গ্রেফতার করা হয়। তাকে নিয়ে শুক্রবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে নান্দাইল চৌরাস্তা এলাকায় পলাতক আসামি প্রান্তকে (২২) গ্রেফতার করতে গেলে প্রান্ত ও তার সহযোগীরা আসামি ইমনকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ও গুলি ছুঁড়ে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে এক পর্যায়ে ইমন পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে সে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসি দাবি করেন, এ বন্দুকযুদ্ধে নান্দাইল মডেল থানার এসআই নাজিম উদ্দিন ও কনস্টেবল মোক্তার হোসেন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে ৩টি গুলির খোসা, ৩টি বড় ছোরা ও ইট-পাটকেলের টুকরা উদ্ধার করা হয়। নিহত ইমনের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/132257