২০ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:১০

নিয়ন্ত্রণহীন পণ্য বাজার

পবিত্র রমজানকে পুঁজি করে দাম নিয়ে পণ্য বাজারে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সরকারের নানা উদ্যোগ, হুমকি-ধমকি এবং হুশিয়ারি কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা যে যার কাছে যেমন পারছে তেমন দাম হাঁকাচ্ছে। এমনকি ক্রেতাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখেও যেন দাম চাওয়া হচ্ছে। অতি মুনাফার নেশায় বাজার যেন লাগামহীন হয়ে উঠেছে ক্রেতাদের কাছে। রমজান মাসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পণ্যগুলোর দাম তাই বাড়ছে হুহু করে। বাজার থেকে শুরু করে ফুটপাত- এমনকি ভ্যান গাড়িতে যেসব পণ্য বিক্রি হয় সেগুলোতেও চলছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। বেগুন, কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, শসা, চিনি, লেবু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল এবং বিভিন্ন ফলের দাম বাড়ছেই। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শেওড়াপাড়া বাজার, নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচা বাজার ও মালিবাগসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোজা শুরুর পাঁচ দিন আগে দাম বাড়তে শুরু করে। প্রথম দু’দিনে সেই দাম আরও বেড়ে গেছে। এছাড়া আগামী ৭ দিন পর্যন্ত দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত রয়েছেন ক্রেতারা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ১২টি সংস্থার ৩৫টি টিম রাজধানীতে কাজ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই- তাই এ অবস্থা।

তবে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারের এ অবস্থা। কিন্তু ক্রেতারা বলছেন, অতি মুনাফাখোড় ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়া কিছুই নয়। ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যানজট ও বৃষ্টির কারণে সরবরাহে কিছুটা টান পড়েছে। তবে ক্রেতাদেরও সচেতন হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। কিন্তু যে পক্ষ যাই বলুক চূড়ান্ত বিচারে পকেট ডাকাতি হচ্ছে ক্রেতাদেরই। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হাঁসফাঁস করছেন বাজারে গিয়ে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, কোন পণ্যে কারা দাম বাড়ায় সরকারের উচিত হবে তা চিহ্নিত করা। একই সঙ্গে কোন স্তর থেকে কতটা বাড়ানো হয় তার যৌক্তিক পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দাম বাড়ার এ প্রবণতায় দুর্বল বাজার মনিটরিংয়ের কারণে ভোক্তাদের কাছে সুফল মিলছে না। তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যের মূল্য কারসাজির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া ভোক্তাদেরও অতি উৎসাহী হয়ে এক দিনে ১০ দিনের পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। যাতে বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্যের ঘাটতি দেখা না দেয়।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শনিবার বাজারে বেগুন বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি দরে। শুক্রবার এ বেগুনই বিক্রি হয়েছিল ৮০-১০০ টাকা কেজি। আবার এক সপ্তাহ আগে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৮০-৯০ টাকায়, যা শুক্রবার ছিল ৬০-৮০ টাকা এবং এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। ধনে পাতা বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি। শুক্রবার বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। এক সপ্তাহে আগে ৪০-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। শনিবার পুঁদিনা পাতা বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে। শুক্রবার ছিল প্রতি কেজি ১২০-১৫০ টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ী কিরণ বলেন, সরবরাহ কম থাকায় ধনে পাতা ও পুঁদিনা পাতার দাম বেড়েছে। শনিবার শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। শুক্রবার বিক্রি হয় ৭০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪০ টাকা কেজি। এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের ফলে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। শুধু ঘটা করে দাম বাড়েনি ছোলা ও ডালের। তবে রাজধানীর একেক বাজারে বিক্রি হচ্ছে একেক দামে। সরকারের একাধিক টিম বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকলেও তা চলছে বিচ্ছিন্ন ভাবে।
শান্তিনগর কাঁচাবাজারে ক্রেতা মো. সিনবাদ বলেন, এবারও রমজানে পণ্যের দাম ভেবেছিলাম বাড়বে না। কিন্তু সেই বরাবরের চিত্রই দেখতে হল। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছেন। যে যেভাবে পারছে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। দেখার যেন কেই নেই। আমাদের পকেট ঢাকাতি করা হচ্ছে। একই মন্তব্য করেন শেওড়াপাড়া বাজারের ক্রেতা আবু তাহের ও জাহাঙ্গীর আলম।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, রোজার আগেই কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা অধিদফতরের পক্ষ থেকে সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজার মনিটরিং করছি। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় কাউকেই ছাড় দেব না। অন্যদিকে বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৮ টাকায়- যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ১০৫ টাকা। বেড়েছে খোলা সয়াবিনের দামও। সাত দিন আগে যে তেল প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৫ থেকে ৮৮ টাকায় তা শুক্রবার বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা- যা সাত দিন আগে ছিল ৩০ টাকা। চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজি। এক সপ্তাহে আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। শান্তিনগর কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাজারে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বাড়তি। চাহিদা বাড়ায় পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। রমজান তাই পণ্য বেশি রাখতে হচ্ছে। কারণ এ সময় বেশি বেচাকেনা হয়। তাই বাজারে সরবরাহ বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাইকারি বাজারে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে সব ধরনের মুড়ির দাম। বড় আকারের মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা- যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। স্বর্ণা ছোট মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা- যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। বরিশালের হাতে ভাজা মোটা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা- যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়। চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। বাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকায়- যা ৭ দিন আগে ছিল ৬০ টাকা। রমজানে মাংসের চাহিদাও বেড়ে গেছে। শনিবার প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়- যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এর বাইরে ১৫ দিন আগে থেকেই অস্থির পেঁয়াজ, রসুন ও আদার বাজার। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়- যা ১৫ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা- যা ওই সময় বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকায়।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/50500