২০ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:১০

বিদ্যুতেও আছে শঙ্কা

রমজানজুড়ে থাকবে গ্যাস ও পানি সংকট

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও রমজানজুড়ে থাকবে তীব্র গ্যাস ও পানি সংকট। তবে গ্যাস সংকট অব্যাহত থাকলে ঢাকার বাইরে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে। গ্যাসের সবচেয়ে বেশি সংকট হবে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায়। যার প্রভাব পড়েছে প্রথম রোজার (বৃহস্পতিবার রাতে) সেহরির খাবার তৈরিতে।

এদিন মধ্য রাত থেকে রাজধানীর অনেক এলাকায় ছিল তীব্র গ্যাস সংকট। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় চুলা পর্যন্ত জ্বলেনি। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় সেহরির খাবার গরম করতে পারেননি নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। দ্বিতীয় রোজার সেহরির সময়েও একই ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তারা।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, রজমানজুড়ে রাজধানীতে গ্যাসের পরিস্থিতি তেমন উন্নতি হবে না। তবে আমদানিকৃত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে এ সংকট থাকবে না। কিন্তু পাইপলাইন প্রস্তুত না হওয়ায় শিগগিরই এলএনজি ঢাকায় আসছে না। কাজেই দ্রুত মিলছে না এর সুফল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কিছুদিন আগে বলেছিলেন, চলতি মাসের শেষ দিকে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যোগ হবে। তখন গ্যাস সংকট আর থাকবে না। সে ক্ষেত্রে চলতি মাসের শেষে এ সংকট কমতে শুরু করবে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার কথা উল্লেখ করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী তখন বলেছেন, রমজানে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে না। চলতি মাসে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। সরকার রমজানে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে বলেও তিনি জানান।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, রোজার প্রথম দিন থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম চাপে পাইপে গ্যাস আসছে। বিশেষ করে ভোর রাত ও দুপুরের পর থেকে অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ একদমই থাকে না। রাত ১১টার পর থেকে কিছু কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হচ্ছে। বাধ্য হয়ে নগরবাসী তখনই প্রয়োজনীয় রান্নার কাজ সেরে নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও রাত ১২টার পর গ্যাস আসছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনে যেখানে স্বাভাবিক সময় গ্যাসের চাপ ৬ পাউন্ড থাকে, সেখানে এখন আছে মাত্র ২ পাউন্ড। বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেও গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে রমজানে সিএনজি গ্যাস স্টেশন ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এছাড়া সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় রমজানের প্রথম দিকে চাপ একটু কম হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আমদানিকৃত এলএনজি যোগ হলে রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় গ্যাসের চাপ বাড়বে। এলেঙ্গা থেকেও সরাসরি রাজধানীতে গ্যাস যুক্ত হবে। তখন আর গ্যাস সংকট থাকবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে রমজানে ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় লোডশেডিং না করতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানি বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের উন্নতি না হলে রমজানে ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে কিন্তু এখন প্রয়োজনের অর্ধেকের চেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রমজানে গ্যাসের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকটও দেখা দেয়ার আশঙ্কা আছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক জনসংযোগ কর্মকর্তা সাইফুল হাসান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় অর্থাৎ সন্ধ্যায় রি-রোলিং মিল, ওয়েল্ডিং মেশিন, ওভেন, ইস্তিরির দোকানসহ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী সরঞ্জাম বন্ধ রাখা, ইফতার ও সেহরির সময় বিপণিবিতান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার সীমিত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সবসময় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ মাসে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। তখন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোথাও আর বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকবে না।

যেসব এলাকায় গ্যাস সংকট বেশি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী, শেখেরটেক, লালবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, মিরপুর, কাজীপাড়া, পশ্চিম ধানমণ্ডি, মধুবাজার, হাজারীবাগ, তল্লাবাগ, ট্যানারি মোড়, মালিবাগ, মগবাজার, উত্তর শাজাহানপুর, দক্ষিণ শাজাহানপুর, গোড়ান, খিলগাঁও, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান এলাকায় গ্যাসের সমস্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের এলাকায় দিনে চুলা জ্বলে না। জ্বললেও মিটমিট করে। কোথাও সকালেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। আবার কোথাও সন্ধ্যায় গ্যাস পাওয়া যায়। কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের চাপ থাকে মূলত রাত ১১টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা শওকত হোসেন বলেন, সকাল ৭টা বাজতে না বাজতেই তাদের এলাকায় গ্যাস চলে যায়। লাইনে টিপ টিপ করে যে গ্যাস আসে, তা দিয়ে রান্না করা যায় না। তিনি বলেন, নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করেও প্রয়োজনের সময় গ্যাস পাচ্ছেন না।
মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়া পানির ট্যাঙ্ক এলাকার বাসিন্দা রাজ্জাক হোসেনের অভিযোগ, তার বাসায় সকাল ৭টা থেকেই গ্যাসের চাপ থাকে না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের চাপও কমতে থাকে। ফলে স্কুলগামী শিশুদের জন্য খুব ভোরেই খাবার-দাবার রান্না করতে হয় তাকে। এখন সেহরি তৈরির আগে গ্যাস থাকে না। একই সঙ্গে দুপুরের পর যখন ইফতারের জন্য রান্না শুরু হবে তখন গ্যাস চলে যায়।
উত্তরখানের আটিপাড়ার বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, সারা দিন গ্যাস থাকে না। রমজানের প্রথম দিন থেকে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় গ্যাস থাকছে না। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনে রান্নার কাজ করছেন এলাকার বাসিন্দারা। এতে বাড়তি খরচ হচ্ছে, পরিবারের মাসিক বাজেট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অভিযোগ করেন নিয়মিত গ্যাস না পেয়েও গ্যাস বিল দিতে হচ্ছে।

তীব্র পানি সংকট : পবিত্র মাহে রমজানেও পানি সংকটে ভুগছেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা। একই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দুর্গন্ধযুক্ত পানিও বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমজানের আগে থেকে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে এলাকাবাসী বিষয়গুলো অবহিত করলেও কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে রমজানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানসহ ভুক্তভোগীরা অন্তহীন ভোগান্তিতে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মাণ্ডা এলাকায় পুরো এক সপ্তাহ ধরে পানি নেই। বাইরে থেকে পানি কিনে, বৃষ্টির পানি ধরে রেখে কোনো রকম বেঁচে আছেন তারা। রমজানে ইফতার, সেহরি, তারাবির নামাজের অজু, খাবার তৈরি এবং গোসলের পানির জন্য একরকম হাহাকার চলছে। এলাকাবাসী পানি সমস্যার কথা ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের জানালেও প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করছেন না।
এ প্রসঙ্গে মাণ্ডা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ফারুক আল হাসান যুগান্তরকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পুরো মাণ্ডা এলাকায় পানি নেই। এ এলাকার লক্ষাধিক বাসিন্দা বাইরে থেকে পানি কিনে নিজেদের চাহিদা পূরণ করছেন। যদিও এভাবে ঠিকমতো তারা গোসল, কাপড় পরিষ্কারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না।

আরও জানা গেছে- বাউনিয়া বাঁধ, উত্তর ইব্রাহিমপুর, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, পীরেরবাগ, বড়বাগ, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, আরামবাগ, মানিকনগর, কালাপানি, কালশী, পশ্চিম মনিপুর, মুরাদপুর, কেদার নাথ দে লেন, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডা, বনশ্রী, পশ্চিম রামপুরা এলাকার বাসিন্দারা পানি সংকটে নাকাল হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২২ জন কাউন্সিলর রমজান শুরুর আগে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তাদের এলাকায় পানি সংকটের কথা জানিয়ে প্রতিকারের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব সমস্যারও সমাধান হয়নি। ওইসব এলাকায় ৯০ ভাগ বাসিন্দা নিয়মিত পানি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কাউন্সিলররা। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পানি সমস্যার বিষয়টি তারা জানিয়েছেন।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে দৈনিক পানির চাহিদা ২৩০-৩৫ কোটি লিটার। কিন্তু এখনও ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ২৪৫ কোটি লিটার। চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্প, ৮৩২ গভীর নলকূপ এবং প্রায় সাড়ে সাতশ’ পাম্পের সাহায্যে এ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত এলাকায় পানির কোন সংকট নেই; তবে পকেট সমস্যা রয়েছে। পাইপলাইন সংস্কার কাজ, যান্ত্রিক ত্র“টিসহ বিভিন্ন কারণে পকেট সমস্যা তৈরি হয়।
রমজানে সেসব সমস্যার সমাধান করতে ১৫টি অভিযোগ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা গ্রাহকরা এসব অভিযোগ কেন্দ্রে তাদের এলাকার সমস্যার কথা জানাতে পারেন। আর তাৎক্ষণিক বিকল্প পন্থায় পানি নেয়ারও সুযোগ রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/50516