১৯ মে ২০১৮, শনিবার, ১০:৩৬

গ্যাস বিদ্যুৎ আর পানির তীব্র সংকটে নগরবাসী

গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি সংকটে শুরু হলো মুসলমানদের সব চেয়ে বড় উৎসবের মাস মাহে রমযান। তার সাথে রয়েছে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিও। এ মাসকে ইবাদতমুখী করতে আয়োজনের শেষ নেই। কিন্তু গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি সংকট সে প্লানকে ম্লান করে দিচ্ছে। রাজধানীজুড়ে সাধ্যমতো আয়োজনে সেহরি খাওয়ার আয়োজন করেছেন নগরবাসী। তবে মধ্যরাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকটে সেহরি তৈরিতে দুর্ভোগের কথা বলেছেন গৃহিণীরা। রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। এতে করে অজু গোসল কিংবা রান্না বান্না করতে পারছে না নগরবাসি। সাথে সাথে বিদ্যুতের লোডশেডিংও।

এতে করে বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টমুখি হচ্ছে রোজাদাররা। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। প্রয়োজনীয় খাবার না খেয়ে অনেককে রোজা রাখতে হচ্ছে। তবে মধ্যরাতের আগ থেকেই রাজধানীর অনেক এলাকায় দেখা যায় গ্যাস সংকট। সেহরি প্রস্তুতিতে এ নিয়ে ভোগান্তির কথা বলেছেন গৃহিণীরা। সারা দিন পানির পাম্পে দাড়িয়েও খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারছে না রাজধানীবাসি।
প্রথম রোজায় রাজধানীজুড়ে কর্মজীবী মানুষও সেহরি খেয়েছেন হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ফুটপাতে। বরকত ও রহমতের এই মাসে অধিক নেকি হাসিলের সুযোগে কর্মজীবী মানুষরা ভুলেছেন পরিবার-পরিজন ছাড়া সেহরি খাওয়ার কষ্ট।

অবস্থা এমন দাড়িয়েছে রাজধানীতে প্রায় ২৪ ঘন্টাই হোটেল খোলা রাখতে হচ্ছে। হোটেলের কর্মচারিদের ২৪ ঘন্টাই ডিউটি করতে হচ্ছে। রাজধানীতে গ্যাস সংকট দীর্ঘদিনের। এই সংকট না কাটিয়ে সরকার দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়ে চলছে। এমন অনেক এলাকা রয়েছে সেখানে গত তিন বছর ধরেই গ্যাস পাচ্ছে না। কিন্তু তাদের নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধও করতে হচ্ছে।
রাজধানীর গ্যাস-সংকট নিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি নিয়ন্ত্রণকক্ষে কর্তব্যরত এক কর্মীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এমন জবাবই দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শীতকালে গ্যাসের কিছু সমস্যা থাকে। কিন্তু রমযান মাসে এরকম গ্যাস সংকট অতীতে আর দেখা যায়নি। এখন তো আর শীত কাল নয় তাহলে কেন গ্যাসের সংকট বাড়ছে। এমন প্রশ্নে কোন জবাব নেই কতৃপক্ষের কাছে। তবে এবার প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহও অনেক কম বলে সমস্যা প্রকট হয়েছে।

এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি আবাসিক গ্রাহকদের। অনেক এলাকায় চুলা জ্বলছে টিমটিম করে। অনেক এলাকায় চুলা জ্বলছে না বললেই চলে। বিশেষ করে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সংকট তীব্র। তা অব্যাহত থাকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। তার পর টিমটিম করে জ্বলে গ্যাসের চুলা। এক ঘন্টার রান্না করতে সময় লাগে ৪ ঘন্টার মত। সারা রাত্র জাগ্রত থেকেও শেষ রাতে সেহেরি খাওয়া যায় না। রাজধানীর নিম্ম এলাকায় পানিতে ডুবে থাকার কারণে গ্যাস পাচ্ছে না গ্রাহকরা। অনেক এলাকায় আবার গ্যাস লাইন লিক হয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে করে তারা একেবারেই গ্যাস সংযোগ পাচ্ছেন না।
এ অবস্থায় অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। যা অনেক গ্রাহকের জন্যই কষ্টকর। শীতকালে সংকট পুরাতন হলেও এবার রমযানে গ্যাস সংকট নতুন। দুপুর থেকে আর চুলা জ্বলেনা। কোনভাবেই ইফতার তৈরি করতে পারছে না গৃহিনীরা। বাধ্য হয়ে হোটেল থেকেই ইফতার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে করে প্রতি জনকে ইফতার করতে ব্যয় হচ্ছে ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। যা একজন রোজাদারের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

গ্যাস-সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক সিএনজি স্টেশন। তেজগাঁও, শ্যামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প-কারখানার উৎপাদনও বিঘ্নিত হচ্ছে গ্যাসের চাপ ঠিক না থাকায়।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালক (উৎপাদন) মীর মশিউর রহমান সমস্যার বিষয় স্বীকার করে বলেন, এক হাজার ৮০০ থেকে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে সার্বোচ্চ এক হাজার সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
পরিচালকের দাবি, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনগুলো যখন বন্ধ থাকে, স্থানীয় আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের সমস্যা হয় না। তারপরেও কেন গ্যাস সংকট হচ্ছে আবাসিক এলাকায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। প্রসঙ্গত, রাজধানী ও আশপাশের এলাকা নিয়ে তিতাস গ্যাস অঞ্চল। গ্যাসের মোট চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশ আবাসিক খাতে ব্যয় হয়।

রাজধানীর ধোলাইপাড় এলাকার গৃহিণী অনামিকা মাহবুব সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্যাসের চুলা ব্যবহার করতে পারেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শীত কালে গভীর রাতে পরদিনের রান্না করতে হতো। তখন আমরা বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করেছি। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে নতুন করে গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে। কি কারনে জানিনা। এতে করে আমরা ইফতার একে বারেই আয়োজন করতে পারছি না। এলাকাবাসি সবাই হোটেল নির্ভর হয়ে পড়ছে।
তীব্র পানি সংকটে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। গরমের মৌসুম শুরু না হতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে মারাত্মক পানি সংকট। কোথাও একমাস কোথাও ১০ দিন ধরে মিলছে না পানি। কোথাও দিনে শুধু এক ঘণ্টার জন্য পানি আসে- বলছেন ভুক্তভোগীরা। তবে এই সংকটের কথা মানতে নারাজ ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের এই শহরে বিশুদ্ধ পানি পাওয়াটা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। দিনের বেশিরভাগ সময়েই অনেক এলাকায় পানি থাকে না, পানির জন্য হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক এলাকায় রান্না, ধোয়ামোছাসহ জরুরি কাজ কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না। কোনো কোনো এলাকায় মসজিদেও পানির সংকট তৈরি হয়েছে। মুসল্লিরা অজু করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। অনেক মসজিদে লিখা রয়েছে অজু বাসা থেকে করে আসুন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পানি সংকটে রান্না ও বাসাবাড়ির কাজ করতে পারছেন না তারা। এ ছাড়া খাবার পানির সংকটে পড়েছেন প্রায় এলাকার মানুষ। বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি আনতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নারীদের।
গত এক মাস ধরে মগবাজারের মধুবাগ ঝিলপাড় এলাকায় পানির সংকট চলছে বলে অভিযোগ। পানির জন্য আশপাশের এলাকায় ছুটছেন অনেকে। বাধ্য হয়ে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকেও সংগ্রহ করছেন। এলাকাবাসী চাঁদা তুলে কিনে নিচ্ছেন ওয়াসার জরুরি সরবরাহের পানি। এতে বড়জোর খাবার চাহিদাই মেটে।

পানির চরম সংকটে পূর্ব রামপুরার স্থানীয়রা বলছেন, বেশির ভাগ এলাকায় ওয়াসার লাইনে পানি আসে দিনে একবার। আর তখনই হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকজন। ১৫ দিন ধরে পানি নেই। প্রতিদিন ৩শ’ টাকা ভাড়া দিয়ে দূর থেকে পানি আনতে হয়।
রামপুরার বাসিন্দা হনুফা বেগম বলেন, রাত ১১টায় কিছুটা পানি আসে আর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পানির জন্য সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে পানি নিতে হচ্ছে। এমনকি এ পানি সংগ্রহ করতে অনেকেরই সারা রাত জেগে থাকতে হয়। এভাবেই গত ১৫দিন ধরে চলছে এলাকার মানুষের। আর কতদিন এভাবে পারব জানি না। কিন্তু এসব দেখারও যেন কেউ নেই।

রাজধানীর মহল্লায় মহল্লায় পানির জন্য হাহাকারের এ সুযোগে ওয়াসার একশ্রেণির অসাধু কর্মচারী পানি বাণিজ্য শুরু করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক গাড়ি পানির দাম ৫শ’ টাকা হলেও দেড় হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে কোনো কোনো এলাকায়। আবার পানি না পেয়ে অনেকে মিনারেল বোতলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যেসব এলাকায় পানির সংকট নেই, সেখানকার পানিও ময়লা দুর্গন্ধের কারণে খাবারের অযোগ্য, এমনটাই বলছেন নাগরিকরা। এমতাবস্থায় চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ওয়াসার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানির এমন সংকট খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মিরপুর, বাসাবো, মগবাজার, মধুবাগ, নয়াটোলা, চেয়ারম্যান গলি, মীরবাগ, বনশ্রী, সেগুনবাগিচা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, মির হাজারিবাগ, দোলাইরপাড়, উত্তরা, কুড়িল, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর অনেক এলাকায়। তবে তা মানতে নারাজ ওয়াসা। তাদের দাবি, চাহিদার চেয়ে উৎপাদনও বেশি।

ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী জানান, রাজধানীর কোনো জায়গায়ই পানির ক্রাইসিস থাকতে পারে না। কারণ চাহিদার চেয়েও বেশি পানি উৎপাদন করছে ওয়াসা। ঢাকায় দৈনিক পানির চাহিদা ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসার উৎপাদন সক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার।
ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ওয়াসার প্রায় পৌনে ৪ লাখেরও বেশি গ্রাহক সংযোগ রয়েছে। তবে একটি বাড়িতে একটি সংযোগ থাকলেও সেখানে বাস করছে একাধিক পরিবার। ফলে বাস্তবে গ্রাহকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এ ছাড়া প্রচুর অবৈধ সংযোগ রয়েছে। যার কারণেই মাঝে মধ্যে পানির সংকট দেখা দেয়। রাজধানীজুড়ে একদিকে পানির সংকট অন্যদিকে ওয়াসার বিষয়টিকে অস্বীকার এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায় রাজধানীবাসী।

একই অবস্থা দেখা গেছে বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও। প্রতি ঘন্টায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। কোন এলাকায় বিদ্যুৎ গিয়ে ৩-৪ ঘন্টায় আসে না। এতে করে অনেকের ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতো গেলো শহরের কথা। তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা গ্রাম এলাকায়। পল্লী এলাকা টানা কত দিন বিদ্যুৎ থাকে না। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে মানুষের মোবাইলেও চার্জ থাকছে না। দিনের পর দিন এভাবে চলছে পল্লী বিদ্যুৎ। সাধারণ রোজাদাররা বলছেন, সারা দিন রোজা রেখে যদি সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ না থাকে তাহলে কিভাবে ইফতার করবো। সন্ধ্যায় কেরসিনের বাতি জ্বালাতে হচ্ছে। এতে করে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রমযানে এ নাগরিক দুর্ভোগ থেকে বাচতে চায় দেশবাসী।

http://www.dailysangram.com/post/330909