১৮ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২৪

রমযান কেন্দ্রিক পণ্যের দাম লাগামহীন

রমযানকে কেন্দ্র করে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে কোন কারণ ছাড়া কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্র। রমযানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগে কাজ করার আশ্বাস দেয়া হলেও তার কোনো প্রভাব দেখা যায়নি বাজারে। বরাবরের মতো এবারও রমযান শুরুর আগেই দাম বেড়েছে প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। একইভাবে বেড়েছে সব ধরনের সাক সবজির দামও।
রাজধানীর কাওরান বাজার, হাতিরপুল ও মালিবাগ যাত্রাবাড়ি মিরপুরসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে কাঁচা সবজির। গত কয়েকদিনের তুলনায় সব ধরনের সবজির দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। পেঁয়াজে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এছাড়া দাম বেড়েছে মুরগি, চিনি, ভোজ্য তেল,আদা, রসুন,মুড়ি,দুধ ও ছোলার। এছাড়াও বেড়েছে,কাচা মরিচ,ধনিয়া পাতা,শসা করলাসহ বেশ কয়েকটি সবজির দাম।
ব্যবসায়িরা বলছেন, পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। পাইকারি পর্যায়ে দাম বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু ক্রেতারা বলছেন, ব্যবসায়িরা দাম বাড়িয়ে অহেতুক কোনো না কোনো অভিযোগ দাঁড় করায়। মূলত রমযানকে টার্গেট করেই তারা দাম বাড়ায়।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারে ক্রেতা মনিরুল বলেন, সবকিছুর দাম বাড়তি। রমযান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা সোহেল বলেন, ট্রাক ভাড়া বেশি, পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। রাস্তায় জ্যাম থাকায় অনেক মালামাল নষ্ট হয়। সেজন্য দাম বাড়ছে।সরকারও তো আর মাল বিক্রয় করে না। তারা বাজারের বাস্তব অবস্থা বুঝে না। এসির মধ্যে বসে থেকে দর নির্ধারণ করলে তো হবে না।
ক্রেতারা বলছেন,রমযান এলই জ্যাম আর গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির অভিযোগ দাড় করায় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সারা বছরই জ্যাম অব্যাহত থাকে। তাহলে কেন রজমানে এ অভিযোগ দাড় করানো হয়। আসলে অভিযোগ কিছু না। এ মাস এলে বেশ কয়েকটি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আর এ পণ্যেই দাম বাড়ে। বাকি পণ্যের কোন দাম বাড়ে না।
কাওরান বাজারের পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বিক্রেতা ইদ্রিস আলী বলেন, ভারতে পেঁয়াজ-রসুনের দাম বাড়ছে, তাছাড়া রমযানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, তাই দাম বাড়ছে। রমযানে চাহিদা বেড়েছে এমন সব পণ্যের দামই শুধু বাড়ছে কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন,চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম তাই দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব দাম বৃদ্ধিতে খুচরা ব্যবসায়ীদের কোন হাত নেই বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন,আমরা বেশি দামে ক্রয় করলে বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়। এতে আমাদের কিছুই করার নেই।
কয়দিন আগেও বেগুন, টমেটো বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। কিন্তু এখন প্রতি কেজি বেগুন ৭৫ থেকে ৮০ টাকা আর টমেটো ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পটল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, মরিচ ৭০ থেকে ৮০ টাকা, করলা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, কচুরমুখি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জানা গেছে ৫/১০ দিন আগেও যে বেগুন বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০ টাকা কেজিতে। তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকা কেজিতে। এর জন্য আসলে কারা দায়ী এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। প্রশ্ন তুললেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ জন্য সরকারের বাজার ব্যবস্থাকেই দায়ী করলেও ক্রেতারা।
রমযান সামনে রেখে বেড়েছে সব ধরনের খেজুরের দাম। খুচরা বাজারে খেজুরের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ দেড় হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা। দাম বাড়ার তালিকায় যোগ হয়েছে আম-লিচুসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল।
রমযানে রোজাদারদের ইফতারের তালিকার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। রোজায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর বিভিন্ন ফলের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রকারভেদে খেজুরের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা।
এক বিক্রেতা জানান, বাজারে নানা ধরনের খেজুর আছে। এর মধ্যে ‘মরিয়ম’ খেজুর এখন কিনতে হচ্ছে প্রতি ৫ কেজি ৩ হাজার ৫০০ টাকা। আমরা সেটাকে ৭৫০ টাকা করে বিক্রি করছি।
একইভাবে বেড়েছে মুড়ির দামও হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা কেজি দরে। যা আগে ছিল ১৮০-২০০ টাকা দরে। মেশিনে ভাজা মুড়ির দামও বেড়েছে কেজিতে ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে ১ কেজি মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। যা আগে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা দরে।
তাদের অভিযোগ সরকার যদি নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতো তাহলে এভাবে বাজার লাগামহীন হতে পারে না। ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছা মত পণ্যে দাম নির্ধারন করছে। এতে ক্রেতাদের দর কষাকষি করার কিছু নেই। বাজার থেকে খালি হাতে ফিরে আসা ছাড়া কোন উপায় নেই তাদের। কারন যারা দেখবাল করার কথা তারাই চুপ।
গত মাসে ভারতে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৬ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ টাকা। এখনও প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমদানি ও সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও বাংলাদেশে দেশীয় পেঁয়াজের সঙ্গে ভারতীয় পেঁয়াজের দরও বেড়েছে।
কাওরান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, গত ১০ থেকে ১৫ দিন আগেও দেশি পেঁয়াজের দর ছিল কেজি প্রতি ৩০ টাকা। এখন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজ ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা যা এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টনের মত। কিন্তু উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টন। তআরও বছরের বাকি আছে ৩ মাস। তাহলে এত পেয়াঁজ গেলো কোথায়।
খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে, যা কয়দিন আগেও ছিল ১০০ টাকা। আর দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, যা ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা টাকা। কেজিপ্রতি আদার দর বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। প্রতি কেজি চীনা আদা ১২০ ও দেশি আদা ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত এক মাসে ছোলার দাম প্রায় ১১ শতাংশ কমে টনপ্রতি ৫৬৭ ডলারে নেমেছে। তবে বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। কয়দিন আগের গড়ে ৬০ টাকার ছোলা মানভেদে এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। গত কয়েক মাস চিনির দাম ৫৩ থেকে ৫৫ টাকায় ঘুরাঘুরি করলেও এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬২ টাকায়।
একইভাবে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দামও। কোন কারণ ছাড়াই প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭-৮ টাকা। খোলা এবং বোতলজাত তেলের দাম বেড়েছে একই হারে। আমদানিকারকরা বলছেন তেলের দাম বৃদ্ধির কোন কারন নেই। পাইকারি বাজারে দাম বাড়েনি। তাহলে কেন খুচরা বাজারে দাম বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও তেলের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বৃষ্টি, রাস্তার জ্যাম ও চাঁদাবাজি এবং বাজারে এক সাথে সব ক্রেতাদের চাপের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ি এই সুযোগ নিচ্ছে। এ জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ক্রেতাদের এক সাথে অনেক পণ্য না কিনে ধাপে ধাপে কিনতে হবে। তাহলে দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
রমযানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে বার বার আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রমযানে চাহিদার তুলনায় পণ্যের মযুদ অনেক বেশি রয়েছে। সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তাই নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট হবে না, দামও বাড়বে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র বলেছিলেন, রমযানে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও সুজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না। তবুও কেউ বাড়তি দাম নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ক্রেতাদের প্রশ্ন মন্ত্রী আর মেয়র এখনও কোথায়। তারা এখন নিরব কেন। প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়লেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন। ক্রেতাদের প্রশ্ন এসব ব্যবসায়ীদের খুটির জোর কোথায়। কিভাবে তারা দাম বাড়িয়ে পণ্য বিক্রি করছে।
সরকারের নানা হুঁশিয়ারি আর পদক্ষেপের পরও এই বাড়তি দাম অনাকাক্সিক্ষত বলছেন তারা। খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ নেই, বলছেন আমদানিকারকরাও। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। এই অবস্থায়, বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি ক্রেতাদের। বিক্রেতাদের অজুহাত, টানা বর্ষণে কমে গেছে সরবরাহ, তাই বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। রমযানে দাম সহনীয় রাখতে এরই মধ্যে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে খোলাবাজারে নিত্যপণ্য বিক্রি করছে টিসিবি।
শুধু ঢাকা শহরেই নয়,সারা দেশেই বেড়েছে নিত্য পণ্যে দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে খোলা ট্রাকে সরকার পণ্য বিক্রি করলেও তার কোন প্রভাব নেই বাজারে।ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজার তদারকিতে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকার সুযোগ নিচ্ছে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী।
সংযমের মাস রমযান। সিয়াম সাধনা আর আত্মশুদ্ধির এই মাসে চাহিদা বাড়ে বেশ কিছু পণ্যের। যার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়, অসাধু ব্যবসায়ীরা। রাজশাহীর খুচরা বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, করলার দাম। বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ মূল্যে।
চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে বেড়েছে, শাক-সবজির দাম। একই চিত্র মেহেরপুর ও সিরাজগঞ্জে। এ দুই জেলায় সবজি চাষ হলেও, বাজার চড়া। রংপুরে বেড়েছে মুরগি ও মশলার দাম।প্রশাসনের দাবি, রোজায় পণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে থাকছে, কঠোর নজরদারি।বাড়তি দাম নিয়ে বিক্রেতারা নানা যুক্তি দেখালেও, ভোক্তারা বলছেন, রমযানে বেশি মুনাফার লোভে লাগামছাড়া সবজির বাজার।

 

http://www.dailysangram.com/post/330824-