১৮ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২২

এক কেন্দ্রে ১৮১৭ ভোটের মধ্যে ১৮১৬ ভোট কাস্ট

খুলনা সিটি করপোরেশনে একটি কেন্দ্রের মোট ভোটার এক হাজার ৮১৭ জন। সেখানে ভোট দিয়েছেন এক হাজার ৮১৬ জন। মাত্র একজন ভোট দেননি। ভোটদানের হার ৯৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ! এ রকমই অস্বাভাবিক ভোটদানের হার দেখা গেছে একাধিক কেন্দ্রে।

এই অস্বাভাবিক ভোটপ্রদানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ১০ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও বিএনপির প্রার্থী মো. ফারুক হিল্টন বলেন, আমার জন্মের পর এবারই একটি আজব নির্বাচন দেখলাম। ভোট শুরু হওয়ার সাথে সাথেই যুবলীগের ক্যাডাররা আমার এজেন্টদের পুলিশের সামনে মারধর করে বের করে দিয়েছে। পুলিশ পাহারায় কেন্দ্রগুলো দখল করে সীল মেরে বাক্স ভর্তি করে। মৃত মানুষের ভোটও তারা গ্রহণ দেখিয়েছে। তিনি বলেন, ৪ হাজার ব্যালটের পেছনে সীল ও স্বাক্ষর ছাড়া এবং মুড়ি বইতেও একই অবস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমি রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। অপরদিকে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘বিএনপি অধ্যুষিত এলাকায় ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে।’
গত মঙ্গলবার খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সব ব্যবস্থাই ছিল-পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ম্যাজিস্ট্রেট ও টহল। এর মধ্যেই প্রতিপক্ষের এজেন্ট বের করে দেয়া, দল বেঁধে বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারা, বাবার সঙ্গে শিশুর ভোট দেয়া, দল বেঁধে জাল ভোট দেয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে ব্যালটে সীল মারতে বাধ্য করা, দুপুরের আগেই ব্যালট শেষ হওয়াসহ নানা ঘটনা ঘটে। তবে এ সব ঘটনার সময় পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কোথাও কোথাও ছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মীদের সহযোগিতার ভূমিকায়।
নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তত ৫৪টি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত কেন্দ্রওয়ারি ভোট প্রদানের তালিকা অনুযায়ী দেখা যায়, নয়াবাটি হাজি শরীয়ত উল্লাহ বিদ্যাপীঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট ভোটার এক হাজার ৮১৭। এর মধ্যে ভোট প্রদান করেছেন এক হাজার ৮১৬ জন। অর্থাৎ একজন ভোটার ভোট প্রদান করেননি। ওই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছেন এক হাজার ১১৪ ভোট। বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন ৩৭৩ ভোট। বাতিল হয়েছে ২৪৭ ভোট। ওই কেন্দ্রে জাতীয় পার্টি তিনটি, সিপিবি তিনটি আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ৭৬টি ভোট পায়।
এই এলাকাটি খালিশপুর থানাধীন অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর থেকে এ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আসছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। কিন্তু এবার নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী যুবলীগ নেতা তালাত হোসেন কাউট ।
একইভাবে নয়াবাটি জনকল্যাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খালিশপুর ভোটকেন্দ্রে মোট ভোট এক হাজার ৬৪৯টি। ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে এক হাজার ৪৪৪টি। ভোট প্রদানের হার ৮৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ওই কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ৯৩৬ ভোট, ধানের শীষ পেয়েছে ৪২২ ভোট। বাতিল হয়েছে ১৬টি ভোট।
মওলানা ভাসানী বিদ্যাপীঠ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের মোট ভোটার এক হাজার ৫০৩। ভোট পড়েছে এক হাজার ৪৬৭টি। ভোট প্রদানের হার ৯৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ৯৯৭ এবং ধানের শীষ পেয়েছে ৩৯০ ভোট। বাতিল হয় ৪৬ ভোট ।
নতুন বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ভোট এক হাজার ৫০৮টি। ভোট পড়েছে এক হাজার ৩৭৮টি। ভোট প্রদানের শতকরা হার ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এখানে নৌকা পেয়েছে এক হাজার ২০২ আর ধানের শীষ পেয়েছে ১৪২ ভোট। এ রকম অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে আরও একটি ভোটকেন্দ্রে। নতুন বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১৫০৮। ভোট পড়েছে ১৩৭৮টি। ভোটের হার ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
অথচ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের গড় হার ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। তিনটি কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৩ কেন্দ্রে। ছয়টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ১২ কেন্দ্রে। ৩০ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।
নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ডের বসুপাড়ায় নুরানি বহুমুখী মাদরাসা কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক দলের একজন সদস্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতার হাতে অপদস্থ হন। তিনি বিষয়টি মোবাইল ফোনে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিজেই কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। তখন পেছন থেকে তাঁকে একরকম ধাওয়া করা হয়। এ কেন্দ্রে প্রকাশ্যে টেবিলের উপর ব্যালটে সীল মারতে দেখা যায়। তাদের বুকে নৌকা ব্যাজ ছিল। সাংবাদিকরা ছবি তুলে ফেললে তাদেরকে ছবি ডিলেট করার জন্য হুমকি দেয়। একজন সাংবাদিকের মোবাইল ফোনও কেড়ে নিতে দেখা যায়।
এদিকে প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের অনতিদূরে নৌকা প্রতীকের একটি করে অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয় ছিল। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে তারা সেখানে অবস্থান নেন। অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা সেখানে প্রথম বাধা পান। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাত বা অপমান-অপদস্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে গেছেন। গণমাধ্যমের কর্মীরা কেন্দ্রে পৌঁছার আগেই, অর্থাৎ সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরুর আধঘণ্টা বা পৌণে এক ঘণ্টার আগেই এক দফা এ ঘটনাগুলো ঘটে।
ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে নৌকা প্রতীকের স্টিকার লাগিয়ে অবাধে চলাচল করেন। এ ব্যাপারে একজন মোটরসাইকেলচালক ছাড়া পুলিশ বা ভ্রাম্যমাণ আদালত কাউকে শাস্তি বা অর্থদন্ড করেছেন, এমন খবর পাওয়া যায়নি।
তবে রাতে ভোট গণনা শেষে যে ফলাফল আসে, তাতে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ভোটারের মধ্যে ৩ লাখ ৬ হাজার ৬৩৬ ভোট পান পাঁচ মেয়র প্রার্থী। বাতিল হয় ৬ হাজার ৫৬৫ ভোট। তবে মোট যে ভোট পড়েছে, তা হিসাব করে দেখা যায়, কাউন্সিলরদের ভোটের চেয়ে মেয়র ভোট ৪১১টি বেশি পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কেবল কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারও কারও জন্য বুথ দখল বা জাল ভোট দেয়া হলে মেয়র প্রার্থীদের মোট ভোটের সংখ্যা কম হতো।
নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেককে বেসরকারিভাবে জয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তিনি পেয়েছেন এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৫১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন এক লাখ ৯ হাজার ২৫১ ভোট। ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৮৬টি কেন্দ্রের ফলাফল দেয়া হয়। তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।
একটি ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত দু’টির তিন কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণ
সদ্য সমাপ্ত খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের অনিয়মের কারণে স্থগিত থাকা সাধারণ একটি ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত দু’টি ওয়ার্ডের তিনটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখনো ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ হয়নি। কেসিসির রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে ফলাফল প্রকাশের অনুমতি চেয়ে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেয় প্রিজাইডিং অফিসার। কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ২০২ নম্বর এবং লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৭৭ নম্বর ও ৩১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কার্যালয় কেন্দ্রের ২৭৮ নম্বর। এ তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে ৩১নং ওয়ার্ডের স্থগিত থাকা দু’টি কেন্দ্র সাধারণ কাউন্সিলর পদে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে।
নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নগরীর ৩১নং ওয়ার্ডে ওয়ার্ডের ১৫টি কেন্দ্রের মধ্যে দু’টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় কাউন্সিলর পদে ঘোষণা করা হয়নি। তবে এ ওয়ার্ডের বাকী ১৩টি কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ভোটে এগিয়ে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফ হোসেন মিঠু। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৮০৪ ভোট। তার কাছাকাছি রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল। তিনি পেয়েছেন ২ হাজার ৬২৮ ভোট। তাদের ভোটের ব্যবধান ১ হাজার ১৭৬। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আসাদুজ্জামান রাসেল পেয়েছেন ২ হাজার ৪০৫ ভোট এবং বিএনপি’র প্রার্থী মো. আসলাম হোসেন পেয়েছেন ৮১৩ ভোট। স্থগিত থাকা দু’টি কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৭০৭।
অন্যদিকে সংরক্ষিত ২টি ওয়ার্ডের ৩টি কেন্দ্রে নির্বাচন করার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে সংরক্ষিত ৯নং ওয়ার্ডের ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ২০২ নম্বর কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে। এ ওয়ার্ডে ৩৩৩ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি’র প্রার্থী মাজেদা খাতুন। তিনি পেয়েছেন ১২ হাজার ১৯৪ ভোট। তার কাছাকাছি রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রুমা খাতুন। তিনি পেয়েছেন ১১ হাজার ৮৬১ ভোট। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিভানা পারভীন ৮ হাজার ৯৯২ ভোট। স্থগিত থাকা কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ১২৪। একই অবস্থা ১০নং ওয়ার্ডের ক্ষেত্রেও। এ ওয়ার্ডের লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৭৭ নম্বর এবং ৩১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কার্যালয়ের ২৭৮নং কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তবে এ ওয়ার্ডের ৩৭ কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫টি কেন্দ্রের ফলাফলে ১ হাজার ৫০৯ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী লুৎফুন নেছা লুৎফা। তিনি পেয়েছেন ১৩ হাজার ৮৪৬ ভোট। তার কাছাকাছি রয়েছেন বিএনপি’র প্রার্থী মিসেস রোকেয়া ফারুক। তিনি পেয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩৭ ভোট। এ ওয়ার্ডের স্থগিত থাকা দু’টি কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৭০৭।

http://www.dailysangram.com/post/330871-