১৮ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২১

দেশে দেশে কমে বাড়ে বাংলাদেশে

বিভিন্ন মুসলিম দেশ বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে রমজান মাসজুড়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় নামেন কে কত কম দামে জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারেন। গোশত থেকে শুরু করে চাল, ময়দা, চিনি, তেল, দুধসহ যাবতীয় নিত্যপণ্যের দাম নেমে আসে অর্ধেকে। অনেক দেশে ভোজ্যতেলের দাম কমে নেমে আসে তিন ভাগের এক ভাগে। কোনো কোনো পণ্য ৯০ ভাগ পর্যন্ত ছাড়ে বিক্রি করা হয়। ব্যবায়ীদের নিজ উদ্যোগে দাম কমানো ছাড়াও অনেক দেশে সরকারিভাবে রমজান মাসে পণ্যের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। 

অপর দিকে ঠিক যেন উল্টো চিত্র বিরাজ করে বাংলাদেশে। কত বেশি লাভ করা যায়, কত বেশি হাতিয়ে নেয়া যায় সে জন্য রমজান মাসের আগমনের জন্য মুখিয়ে থাকেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। অনেকে অপেক্ষায় থাকেন রমজানে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হওয়ার জন্য। রমজান মাস সত্যিই বরকতের মাস বাংলাদেশের অতি লোভী, প্রতারক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর কাছে। আর তাদের এই অতি লোভ, প্রতারণাসহ নানা ধরনের নৈরাজ্যের কারণে রমজান মাস বাংলাদেশের সাধারণ বিশেষ করে শহরের মানুষের কাছে এখন যেন পরিণত হয়েছে বিড়ম্বনা, হয়রানি আর নানা ধরনের জিল্লতি হিসেবে। কেন এই পরিস্থিতি? রমজান শুরুর আগেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে বিভিন্ন জিনিসের দাম। বাড়তে থাকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতিসহ নানা প্রতারণা। রাজধানীতে অসম্ভব হয়ে পড়ে নির্বিঘেœ চলাফেরা। আর এবার রাজধানীর সড়কের যা অবস্থা তাতে মানুষ যানবাহন ব্যবহার তো দূরের কথা হেঁটেও বাসায় পৌঁছতে পারবে কি না সন্দেহ। পরম সৌভাগ্যে আর রহমতের মাস রমজানকে বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ পরিণত করেছে অতি কষ্টের একটি মাস অনেক মানুষের জন্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরম সৌভাগ্যের এ মাসকেই বেছে নিচ্ছে এ দেশের একশ্রেণীর দুর্ভাগা মানুষ তাদের আখের গোছানোর জন্য। আর এ জন্য তারা মানুষের কষ্ট আর ভোগান্তির বিন্দুমাত্র পরোয়া করেন না।
রমজানে চাহিদা বাড়ে বিশেষ কিছু পণ্যের। আর এ সুযোগে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বাড়িয়ে দেয় সেসব পণ্যের দাম, বাজারে কোনো ঘাটতি না থাকলেও। বহুকাল ধরে রমজান যেন বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাস। আর এ দেশে অনেক পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা আর কখনো কমে না। এভাবে প্রতি রমজানে বাংলাদেশে কিছু পণ্যের দাম নিয়মিত বাড়ছে এবং সারা বছরের জন্য সেই বর্ধিত মূল্যই চালু হয়ে যায়। বিশেষ করে গরুর গোশতের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে এ ধারাই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। শুধু কি জিনিসের দাম বৃদ্ধি করেই এরা ক্ষান্ত থাকে? কত ধরনের প্রতারণা আর ভেজাল দিয়ে জিনিসপত্র চালিয়ে দেয়া যায় চলে তার প্রতিযোগিতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
অথচ বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাসে চলে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে রমজান মাসজুড়ে চলে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা। সরকারিভাবে যেমন বিভিন্ন জিনিসের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করে দেয়া হয় তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও ব্যবসায়ীরা দাম কমানো এবং বিশেষ ছাড়ের প্রতিযোগিতায় নামেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবার শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত পণ্যের ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে রমজান উপলক্ষে। সাধারণ আয়ের মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন রমজান মাসে কম দামে জিনিসপত্র কিনে সংগ্রহের জন্য। বিশেষ করে গরিব প্রবাসীদের জন্য রমজান মাস সেখানে আনন্দের বন্যা বয়ে আনে কেনাকাটার জন্য। অনেকে নামমাত্র মূল্যে পণ্য কিনে জাহাজ ভরে দেশে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেন।
এ বছর রমজানে মূল্যছাড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে আরব আমিরাত। খালিজ টাইমস পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজান উপলক্ষে ৯০ ভাগ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রায় এক হাজার পণ্যের ওপর এ ছাড়া দেয়া হয়েছে। এ জন্য যাবতীয় ঘাটতি মন্ত্রণালয় বহন করবে।
সৌদি আরবেও শুরু হয়েছে এবার রমজান উপলক্ষে ছাড়ের হিড়িক। ৭০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সৌদি আরবের বড় বড় চেইন শপ, সুপার মার্কেট থেকে শুরু কর ছোট ছোট দোকানেও ছাড়ের হিড়িক শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ছাড়ের বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লিফলেট প্রকাশ করে তা মানুষের বাড়ি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে।
সৌদি আরবে নির্দিষ্ট পণ্যে সরকার ঘোষিত ছাড়ের বাইরেও ব্যবসায়ীরা অনেক সময় আরো ছাড় দিয়ে থাকেন। সৌদি আরবে পাঁচ কেজি ওজনের বাসমতি চালের ব্যাগ গত রমজানের আগে বিক্রি হতো ৩৮ রিয়াল আর রমজানে তা বিক্রি হয়েছে ১৯.৯৫ রিয়াল দরে। দশ কেজি চিনির ব্যাগ রমজানের আগে ছিল ৩১.৯৫ রিয়াল আর রমজানে বিক্রি হয় ১৪.৯৫ রিয়ালে। দশ কেজি ময়দা স্বাভাবিক সময়ে বিক্রি হয়েছে ৩৫ রিয়ালে আর রমজানে বিক্রি হয়েছে ১৮.৯৫ রিয়াল। পৌনে দুই লিটার ভোজ্যতেলের ক্যান ১২.৫০ রিয়াল থেকে নেমে যায় ৪.৯৫ রিয়াল। এভাবে মাছ-গোশতের দামও রমজানে অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি হয় সেখানে।
কাতারে রমজান মাস শুরুর বেশ আগে থেকেই বিশেষ ছাড়ে জিনিসপত্র বিক্রি শুরু হয়ে যায়। গালফ টাইমস পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে, গত ৫ মে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে কাতারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তালিকায় যেসব পণ্যের দাম কমানো হয়েছে সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস উপলে এ পদপে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রী কেনার েেত্র এই উদ্যোগ সহায়ক হবে।
ময়দা, চিনি, চাল, পাস্তা, তেল, দুধসহ রমজানে সাধারণভাবে ব্যবহৃত সব পণ্যের দাম কমানো হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও অন্যান্য জিনিসের দামও কমানো হয়েছে। দোকানগুলোতে এ তালিকা প্রকাশ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
পাকিস্তান সরকার রমজান উপলে ১৭৩ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর উদ্দেশ্য রমজান মাসে যেন জিনিসপত্রের দাম না বাড়ে। সরকারি আদেশে বলা হয়েছেÑ এ প্যাকেজের আওতায় গরিব মানুষ কম দামে জিনিসপত্র কেনার সুযোগ পাবে।
শুধুু মুসলিম দেশ নয়, আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডেও রমজান মাস উপলক্ষে মুসলমানসহ সবার জন্য পণ্যে বিশেষ ছাড় ঘোষণা করে। এ ছাড়া ফ্রান্সসহ অনেক দেশে মুসলমান ব্যবসায়ীরা রমজানে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে থাকে প্রতি বছর।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/319435