১৭ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

মিডিয়ার চোখে খুলনা নির্বাচনের নগ্নচিত্র

‘খুলনা সিটি নির্বাচনে পরিবেশ দৃশ্যত শান্ত, তবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে’, ‘এটাই ভোট : খুলনায় নির্বাচনের নতুন মডেল’, ‘আমাদের কষ্ট হবে ভেবে ভোটটা ওরাই দিয়ে দিয়েছে’, ‘কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে জাল ভোটের গ্রুপ’, ‘খুলনায় ভোট ডাকাতির মহোৎসব’, ‘ব্যাপক অনিয়মের নির্বাচনে খুলনার নৌকা বিজয়ী’। এসব শিরোনামে গতকাল বুধবার জাতীয় দৈনিকসমূহ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। পাশাপাশি প্রকাশ্যে জালভোট দেয়ার ছবিও প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। ফেসবুকে মৃত মানুষের ভোট দেয়ার চিত্র তুলে ধরেছেন পিনাকী ভট্টাচার্য নামক একজন ব্লগার। তিনি লিখেন, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে একজন বয়স্ক মানুষ ভোট দিতে এসেছেন। পোলিং অফিসার বললেন, দাদু আপনার ভোট তো হয়ে গেছে, বয়স হয়েছে তো তাই মনে রাখতে পারেন না। বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে বললেন, হু তা ঠিক। তবে একটু দেখবেন যে আমার স্ত্রী ভোট দিয়ে গেছেন কি-না? আমার স্ত্রীর নাম কুলসুম বেগম। পোলিং এজেন্ট দেখেটেখে বললো, হ্যাঁ, দাদু, দাদীর ভোট তো হয়ে গেছে। বৃদ্ধ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ওগো, এতোদিন ধরে একসাথে ঘর করে এই প্রতিদান? পরপার থেকে তুমি ভোট দিতে আসতে পারো আমার বাসায় তুমি আসতে পারোনা? আমার চাইতে ভোট তোমার প্রিয় হল?

এ ধরনের জালিয়াতির নির্বাচনকে ‘চমৎকার’ ও ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন হিসেবে নির্লজ্জের মতো স্বীকৃতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে খুলনার এ নির্বাচনে জালিয়াতির সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে রাষ্ট্রদূত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লম বার্নিকাট খুলনার নির্বাচনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় “খুলনা সিটি নির্বাচনে পরিবেশ দৃশ্যত শান্ত, তবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে” শিরোণামে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ছিল শান্ত, তবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন কেন্দ্রে জোর করে বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারা, জাল ভোটের ঘটনাও ঘটেছে। তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশের বিরুদ্ধে দর্শকের ভূমিকায় থাকার অভিযোগ উঠেছে।
প্রথম আলোর পাঁচজন প্রতিবেদক ও তিনজন আলোকচিত্রী ৮০টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে অন্তত ৬০টি কেন্দ্রেই ধানের শীষ প্রতীকের পোলিং এজেন্টদের পাওয়া যায়নি।
বিএনপির অভিযোগ, আগে থেকেই ধরপাকড় ও হুমকি-ধমকিতে তাদের নেতা-কর্মীরা ছিলেন মাঠছাড়া। বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ঢুকতে পারেননি কিংবা বের করে দেয়া হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, জোর করে সরকারি দল জয় কেড়ে নিয়েছে। এটা ছিল কলঙ্কিত নির্বাচন। নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সে সম্পর্কে আজ বুধবার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়ার কথা জানান তিনি।

তবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা জানা গেছে, সেগুলো কাউন্সিলর প্রার্থীদের। সেটার দায় মেয়র প্রার্থী কেন নেবে।’
দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় “এটাই ভোট: খুলনায় নির্বাচনের নতুন মডেল” শিরোণামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাবার সঙ্গে ভোট দিয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে। কেন্দ্রের বাইরে লাইন। ব্যালট পেপার শেষ। আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান- সবচেয়ে কমন ডায়ালগ। জাল ভোটের রীতিমতো উৎসব। বাধা দেয়নি কেউ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহায়ক ভূমিকায়।
এমনই এক অভূতপূর্ব ভোটের সাক্ষী হলো খুলনা। গায়েবি ভোটের নয়া মডেলও বলা চলে। হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই। ভোটের আগে থেকেই নানা গুজব ছিল মুখে মুখে। সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রার্থী এবং ভোটাররা। নির্বাচনের দিন গুজব আর শঙ্কারই বাস্তবচিত্র দেখা গেল ভোটে। দখল আর অনিয়মের কারণে তিন কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত রাখলেও বাকি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে অন্তত ১৫০ কেন্দ্র দখল করে একতরফা নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে খুলনার নির্বাচন অনেকটা অগ্নিপরীক্ষা ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য। নির্বাচন শেষে গতকাল গণমাধ্যমের সামনে আসেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। কমিশন সচিব নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্তত এ নির্বাচনটি শতভাগ সুষ্ঠু করে কমিশন বিরোধী পক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারতো। এখন তাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে খুলনার নির্বাচনে দৃষ্টি ছিল সারা দেশের। নির্বাচনের ফলের চেয়ে নির্বাচন কেমন হবে এটি নিয়ে উৎসাহ ছিল বেশি। দিনের শেষে নির্বাচনের ফল দেখে হতাশ হয়েছেন অনেকে।

“আমাদের কষ্ট হবে ভেবে ভোটটা ওরাই দিয়ে দিয়েছে” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেলা তখন সাড়ে ১১টা। খুলনা নগরীর রূপসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনে বিশাল জটলা। রয়েছে বিজিবি-পুলিশের বহর, কড়া পাহারা। এরইমধ্যে একজন হম্ভিতম্ভি করে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে তারই পরিবারের দুই সদস্য। ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ জানালেন।

একইসঙ্গে ব্যঙ্গ করে বললেন, আমাদের কষ্ট হবে ভেবে ভোটটা ওরাই দিয়ে দিয়েছে। সব ব্যালট পেপার শেষ। এ সময় সেখানে ছুটে আসলেন নৌকা প্রতীকের ব্যাচ পরা বেশ কয়েকজন। সাংবাদিকদের সামনেই তাকে শাসালেন। তাদের হুমকিতে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান লোকটি। এরপর মূল গেটের জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় মহিলা ভোট কেন্দ্রের পাশে একটি গাছের নিচেই বসে আছেন এক বৃদ্ধা। নাম আম্বিয়া। ভোটার নম্বর ৪৭২। ভোট দিতে না পেরে হা-হুতাশ করছেন।

“কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে জাল ভোটের গ্রুপ” শিরোনামে মানবজমিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ এক অন্য রকম ভোট। স্থায়ীভাবে ভোটকেন্দ্র দখল না করলেও নগরীজুড়ে ছিল আতঙ্ক। নগরজুড়ে সব কেন্দ্রেই ছিল সরকারদলীয় প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের লোকজনের আধিপত্য। ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি গ্রুপ জাল ভোট দেয়ার মিশনে নামে। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাল ভোট দেয়া চালিয়ে যায় নিশ্চিন্তে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক বের হলেই কেন্দ্র দখলে নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে সিল মেরে বাক্স ভরে সটকে পড়ে তারা।

তারা সকাল ৮টা থাকে ১০টা পর্যন্ত প্রথমে রেকি করে কয়েকটি কেন্দ্রে। বিএনপি সমর্থিত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সমর্থকদের দুর্বল অবস্থান ও সাংবাদিকদের মুভমেন্ট দেখে ১০টার পর শুরু করে জাল ভোট দেয়ার মিশন। ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী তালকুদার আবদুল খালেক প্রবেশ করেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের নূর নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এ সময় সাংবাদিক ও কিছু পর্যবেক্ষকও প্রবেশ করেন তাঁর সঙ্গে। কেন্দ্র পরিদর্শন করে বের হয়ে এলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে সাংবাদিকরাও বের হয়ে আসেন। এমন সময় নগর যুবলীগ নেতা জাকির ও কানা রানার নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি গ্রুপ আচমকা প্রবেশ করে ভোটকেন্দ্রের ভেতর। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইং অফিসার ও ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে শুরু করেন জালভোট প্রদান। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে সামনে থাকা সব ব্যালট পেপারের বান্ডিলে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে মুহূর্তের মধ্যে কেন্দ্র ত্যাগ করে। খবর পেয়ে মিডিয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসতে আসতে সটকে পড়ে তারা। চলে যায় পরবর্তী কেন্দ্রে। একইভাবে প্রতিটি কেন্দ্রে তালুকদার আবদুল খালেক ভেতরে অবস্থান কালে জালভোট গ্রুপ কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেয়। খালেক ও সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকরা বের হয়ে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই একযোগে প্রবেশ করে মুহূর্তেই সব ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে সটকে পড়ে তারা।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় “বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট বিক্ষিপ্ত সহিংসতা: এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ” শিরোণামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ, কেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শোডাউন এবং বিক্ষিপ্ত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। এদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের সময় বড় কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ভোট গ্রহণের শুরুতে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময় ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেছে। তবে বেলা গড়াতেই ভোট কেন্দ্রের এ উৎসবের দৃশ্যে অনেকটা ভাটা পড়ে। বেলা ১১টার পর থেকে অনেক ভোট কেন্দ্রের সীমানার ভেতর ও বাইরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে তিনটি ভোট কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। জাল ভোটকে কেন্দ্র করে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আ’লীগ ও বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ ১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে।

এ ছাড়াও দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় সংবাদের শিরেনামে বলা হয়, ‘ব্যাপক অনিয়মের নির্বাচনে খুলনার নৌকা বিজয়ী’। ডেইলী স্টার পত্রিকার একটি প্রধান ছবিতে দেখা যায়, ফাতেমা হাইস্কুলে প্রকাশ্যে জালভোট দেয়ার পর ব্যালট পেপারের বইয়ের মুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে ভোট জালিয়াতির নগ্ন চিত্র সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কোন ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো চমৎকার নির্বাচন আখ্যায়িত করে গণতন্ত্রের সর্বনাশই ডেকে আনছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

http://www.dailysangram.com/post/330726