১৬ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:৪০

‘আমাদের কষ্ট হবে ভেবে ভোটটা ওরাই দিয়ে দিয়েছে’

বেলা তখন সাড়ে ১১টা। খুলনা নগরীর রূপসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনে বিশাল জটলা। রয়েছে বিজিবি-পুলিশের বহর, কড়া পাহারা। এরইমধ্যে একজন হম্ভিতম্ভি করে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে তারই পরিবারের দুই সদস্য। ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ জানালেন।
একইসঙ্গে ব্যঙ্গ করে বললেন, আমাদের কষ্ট হবে ভেবে ভোটটা ওরাই দিয়ে দিয়েছে। সব ব্যালট পেপার শেষ। এ সময় সেখানে ছুটে আসলেন নৌকা প্রতীকের ব্যাচ পরা বেশ কয়েকজন। সাংবাদিকদের সামনেই তাকে শাসালেন। তাদের হুমকিতে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান লোকটি। এরপর মূল গেটের জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় মহিলা ভোট কেন্দ্রের পাশে একটি গাছের নিচেই বসে আছেন এক বৃদ্ধা। নাম আম্বিয়া। ভোটার নম্বর ৪৭২। ভোট দিতে না পেরে হা-হুতাশ করছেন।

তিনি বললেন, আমি ভোট দিতে আসলাম। কিন্তু ওরা বলছে, আমাকে ভোট দেয়া লাগবে না। আমার ভোট নাকি ওরা দিয়ে দিয়েছে। স্লিপ নিয়ে বসে থাকা হাসিনারও একই বক্তব্য। কেন্দ্রের সামনে জড়ো হওয়া বেশ কয়েকজন বলেন, পুলিশের সহযোগিতায় একদল যুবক ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছে। পুলিশই ভোট না দিয়ে আমাদের চলে যেতে বলেছে। গতকাল খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এ চিত্র ৩০ নং ওয়ার্ডের ২৬৫ নং কেন্দ্রে। শুধু এই কেন্দ্রেই নয়, পাশেই অবস্থিত রূপসা উচ্চ বিদ্যালয়ের চিত্রও একই দেখা গেছে। কোথাও কোথাও প্রিজাইডিং অফিসারের সামনেই জাল ভোটের মহোৎসব চলেছে। প্রায় সবক’টি কেন্দ্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে সাধারণ ভোটাররা। রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, ভোটাররা ভোট দিতে এসেছেন, কিন্তু ব্যালট পেপার নেই। অনেকেই তাই বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কেন্দ্রের ৪টি মহিলা বুথে ২ নং কক্ষে একজন মহিলা পোলিং অফিসার বসা। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ প্রার্থীর কোন এজেন্টই নেই। টেবিল ফাঁকা। নেই কোনো ব্যালট পেপার। পোলিং অফিসার রাশেদা আক্তার জানালেন, তার বুথের তিনশ’ ভোটই কাস্ট হয়ে গেছে ভোট শুরু হওয়ার মাত্র তিনঘণ্টায়। এই অল্প সময়ে কীভাবে এতো ভোটার ভোট দিলো, জানতে চাইলে বলেন, ভোটাররা একসঙ্গে এসে দিয়ে গেছে। এরপর তিনি আর কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে যান। কেন্দ্রের আরো তিনটি বুথেও একই অবস্থা। বুথের পোলিং অফিসার ও প্রার্থীর এজেন্টরা তখন অনেকটাই হতভম্ব। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই তাদের ওপর দিয়ে সিডর বয়ে গেছে। তবে কেউ মুখ খুলছেন না।

অবশেষে মুখ খুললেন, পারভীন নামে এক পোলিং এজেন্ট। তিনি বললেন, আধাঘণ্টা আগে এখানে একদল যুবক প্রবেশ করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়েছে। তারা নৌকা প্রতীকে সমানে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে চলে গেছে। তখনও এই চারটি বুথের সামনে অপেক্ষা করছেন অনেকে। এই চারটি বুথে ভোটার সংখ্যা ১৩৬০টি। এই কেন্দ্রের সামনেই অবস্থিত রূপসা উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে ভোটার সংখ্যা ১৬৭৩। এই কেন্দ্রে জাল ভোটের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনি আসার পরই সেখানে হট্টগোল বেধে যায়। এরপর সেখানে হাজির হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। পুলিশ জাল ভোট দেয়া যুবকদের বের করে আনে। এ সময় এক পুলিশ সদস্যকে বলতে শোনা যায়, এতো দেরি করলে হয়? সাংবাদিকরা চলে আসার আগেই কাজ শেষ করতে পারতো। এ সময় তিনি নৌকার ব্যাচ পরা এক ব্যক্তিকে আপাতত যুবকদের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য বলেন। এদিকে ওই ভোট কেন্দ্রের দোতলায় ১ নং কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, পোলিং অফিসার মোশাররফ হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বলেন, সকাল থেকে সুষ্ঠুভাবেই ভোট গ্রহণ চলছিলো। কিন্তু সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করেই ১৫-২০ জন যুবক ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। এরপর হুমকি-ধামকি দেয়। তারা নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে থাকেন। ওই কেন্দ্রের আরেকটি কক্ষের পোলিং অফিসার জানান, তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিলো। এদিকে ওই কেন্দ্র থেকে চলে আসার সময় দেখা যায় আরো কয়েকজন যুবক প্রবেশ করছে। তাদের পেছন পেছন গিয়ে দেখা যায়, তারা একজন পোলিং এজেন্টের কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে ভোট দিচ্ছেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর ৩১ নং ওয়ার্ডের দিকে যেতেই একদল নারী-পুরুষ ঘিরে ধরেন। জানান, তারা ধানের শীষ ও বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট।

তাদের অভিযোগ, ১৭৯ নং কেন্দ্রের সবগুলো বুথ থেকে তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। এরপর সেখানে বহিরাগতরা প্রবেশ করে নৌকা ও আওয়ামী সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারছে। এ সময় সেখান থেকে যাচ্ছিলো দুই গাড়ি বিজিবি। পোলিং এজেন্টরা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বিষয়টি দেখতে বললেও, বিজিবি সদস্যরা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যান। একই ওয়ার্ডের লবণচরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে পুলিশের জটলা। বিদ্যালয়ের ভেতরে যেতেই অনেক ভোটারের বিক্ষিপ্ত ঘুরাফেরা দেখা যায়। একজন নারী ভোটার জানান, তিনি ভোট দিতে এসেছেন কিন্তু পুলিশ তাকে কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। দেখা যায়, প্রত্যেক কক্ষের সামনে একজন করে পুলিশ। আর ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে জাল ভোটের মহোৎসব। সেখানে বেশ কয়েকজন নারী জাল ভোট দিচ্ছিলেন।

ছবি তুলতে গেলেই তারা সরে পড়েন। এরপর দোতলায় পুরুষ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। পোলিং অফিসারের সামনে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকে সিল মারা বেশ কয়েকটি ব্যালট পেপার। তার সামনেই ছিলেন, প্রিজাইডিং অফিসার রুকুনুজ্জামান। এ সময় সাংবাদিকদের দেখে তিনি সরে পড়ার চেষ্টা করেন। পরে সাংবাদিকদের জেরার মুখে পড়েন তিনি। একই সময় সেখানে যান প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী ঢাকা থেকে আগত নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আবদুল বাতেন। তিনি ব্যালটগুলো দেখে বলেন, এভাবে কেন? গুছিয়ে রাখেন। এরপর পোলিং অফিসার সেগুলো গুছিয়ে রাখেন।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আবদুল বাতেন। সেখান থেকে রূপসা ব্রিজের নিচেই যেতেই বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আসলাম হোসেন ও তার লোকজন ঘিরে ধরেন। বলেন, পুরাতন কমিশনারের কার্যালয়ে অবস্থিত কেন্দ্রে তাদের সব এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে। এরপর তিনি সেখানে অবস্থান করলে, ধাওয়া দেয় নৌকার সমর্থকরা। পরে যুবলীগ-ছাত্রলীগের লোকজন তার বাড়িতে হামলা করে। তার বৃদ্ধ পিতা ও ছোট ভাইকে মারধর করে। বৃদ্ধ পিতাকে লাথি মারে। হাজী আবদুল মালেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে যেতে ফয়সাল নামে এক ভোটার পথরোধ করেন। তিনি বলেন, আমি একজন ভোটার। ভোট দিয়ে আসলাম। কিন্তু তারা আগে থেকেই বেশ কিছু ব্যালট পেপারে সিল মেরে রাখছে। কেউ ভোট দিতে গেলে তাদের হাতে ১০টি করে ব্যালট ধরিয়ে দিচ্ছে বাক্সে ঢুকানোর জন্য। পুলিশ পাহারায় এগুলো হচ্ছে বলে জানান। ওই বিদ্যালয়ে পৌঁছানো মাত্রই সাংবাদিক আসছে বলে আগেই সতর্ক করে দেয়া হয় ভেতরে। এরপর দেখা যায়, কোন ভোটার নেই। প্রত্যেক কক্ষে ১০-১৫ জন যুবক নীরবে বসে আছে। বাইরে ভোট দিতে না পারা অনেকে জানান, বসে থাকা ওই যুবকরাই জাল ভোট দিতে বাধ্য করছে। আবার অনেককে সামনেই ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের ভোট অত্যন্ত সুষ্ঠু বলে দাবি করেন প্রিজাইডিং অফিসার মহিতোষ পাল ও ঢাকা থেকে আসা পুলিশ কর্মকর্তা রাশেদ। এছাড়া পার্শ্ববর্তী শিশু বিদ্যালয় নামে আরেকটি কেন্দ্রেও জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে।

এদিকে ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, ভোটারের উপস্থিতি খুবই কম। বুথে দেখা গেছে, ৩ ঘণ্টায় মাত্র ২০-৩০টি মতো ভোট কাস্ট হতে। যেখানে ভোটারের সংখ্যা ৪০০-৪৫০। এছাড়া বেশিরভাগ কেন্দ্রেই বিএনপির পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ এসেছে, নগরীর ১৫, ২২, ২৫, ২৬, ২৯, ৩০ এবং ৩১ নং ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=117576