১৬ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:৩১

উজানে টইটুম্বুর গঙ্গা ॥ ভাটিতে পদ্মায় চরের বিস্তার ॥ দু’দশকেও রিভিউ নেই পানিচুক্তির

আজ ১৬ মে, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে এদিন মরণবাঁধ ফারাক্কার মাধ্যমে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে ফারাক্কার উজানে গঙ্গা-হুগলী নদী এই শুকনো মওসুমেও পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও ভাটিতে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। দীর্ঘ দু’দশক অতিক্রান্ত হলেও গঙ্গার পানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত পানিচুক্তির রিভিউ হয়নি।

ফারাক্কা লং মার্চ : ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঙ্গার উপর নির্মিত ভারতীয় বহুমুখী বাঁধ ফারাক্কার অভিমুখে ঐতিহাসিক লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ঐদিন সারা দেশ থেকে রাজশাহীতে জমায়েত হওয়া লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে স্মরণকালের বৃহত্তম মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে মওলানা ভাসানী চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট গমন করেন এবং সেখানে সমাবেশের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি সমাপ্ত হয়। দেশের অভ্যন্তরে এই কর্মসূচি পালিত হলেও এর রেশ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায়। আজও এই দিনটি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর সেদিনের লং মার্চ ছিল বাংলাদেশে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লাখো জনতার এক বজ্রনির্ঘোষ প্রতিবাদ যা দিল্লীর মসনদেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী নানা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো জনপদ। বেলা ২টায় লাখো মানুষ গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লং মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে পৌঁছায়। কলেজ মাঠেই রাত যাপনের পর সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লং মার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক প্রতিবাদ পদযাত্রা গোটা জাতির চেতনাকে শাণিত করে। একদিকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার যখন ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে দর কষাকষি করছিল, তখন মওলানা ভাসানীর এই পদযাত্রা সরকারের দর কষাকষিতে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে। সরকার সাহসী হয় ফারাক্কা সমস্যা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘে উত্থাপন করতে।
এদিকে গত চার দশকে পদ্মার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফারাক্কার প্রভাবে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অসংখ্য নদী। ফারাক্কা চুক্তির নামে ভারতের পানি-প্রতারণাও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পরও বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির সর্বনিম্ন হার অব্যাহত রয়েছে। শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা বাঁধ পেরিয়ে এতো কম পানি আর কখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি গঙ্গা চুক্তি যখন ছিল না সেই সময়টাতে পানি নিয়ে এমন দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে। পানি না পাবার প্রধান কারণ, উৎস থেকে শুরু করে গঙ্গার মাঝপথেই পানির সিংহভাগ প্রবাহ সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে পর্যাপ্ত পানি ফারাক্কা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। সে কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশকে দেবার মতো যথেষ্ট পানি থাকে না।

ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার : ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। এর ফলে একদিকে হুগলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কোলকাতা পোর্ট সারাবছর সচল থাকবে এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে। এখানেই শেষ নয়, ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি রুপি। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে কমে যাবে তা পানির মতোই পরিষ্কার। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি সত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘ন্যায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না। ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ।

নদীসদৃশ ৬টি ক্যানেল প্রকল্প : ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।

চুক্তি রিভিউ জরুরি : এদিকে উজানে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় প্রমত্তা পদ্মা এখন মরা খালে পরিণত হতে থাকলেও চুক্তিটি আর রিভিউ করা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত ৩০ বছরমেয়াদি চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চুক্তি কার্যকর হয়েছে। চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, শুষ্ক সময়ে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বছরই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই চুক্তি পাঁচ বছর পরপর উভয় সরকার রিভিউ করবে। যদি প্রয়োজন হয় অন্তরবর্তীকালীন রিভিউ করা যাবে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, আগামী দুই বছর পর যদি কোনো পক্ষ চুক্তিটি রিভিউ করতে চায় তা করা হবে। সমঝোতার ব্যত্যয় ঘটলে বা সমন্বয়ের অভাব দেখা দিলে এই রিভিউ হবে। কিন্তু ২২ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তিটি রিভিউ করা হয়নি। চুক্তিমতে ফারাক্কায় যে পানি জমে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গার পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। ফলে চুক্তির পানি দিয়ে বাংলাদেশের চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না। ফলে চুক্তির রিভিউ করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

রাজশাহীতে কর্মসূচি : ফারাক্কা লং মার্চের ৪২তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার সকালে রাজশাহীর মালোপাড়ায় অনুরাগ কমিউনিটি সেন্টারে ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের গুরুত্ব’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক এবং প্রধান বক্তা থাকবেন জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশনের সমন্বয়ক এ্যাড. হাসনাত কাইউম। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সাংবাদিক সরদার আবদুর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি এ্যাড. এনামুল হক।

http://www.dailysangram.com/post/330638