১৬ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:২৬

ভোট ডাকাতি ব্যালট ছিনতাই কেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে কেসিসি নির্বাচন সম্পন্ন

ব্যালট পেপার ছিনতাই, নৌকায় সীল মারা মুড়িবইসহ ব্যালট উদ্ধার, প্রার্থীদের ক্যাম্প ভাংচুর, এজেন্টদের মারধর, কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া ও নির্ধারিত সময়ের পরেও কেন্দ্র দখল করে নৌকায় সীল মারার মধ্য দিয়ে খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) ৫ম তম নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলী করে কেন্দ্র দখল করে নেয়। এসব কারণে ২৪ নং ওয়ার্ডের ২০২ নং ইকবাল নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ৩১ নং ওয়ার্ডের ২৭৭ নং লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই ওয়ার্ডের ২৭৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয় বলে জানান রিটার্নিং অফিসার মো. ইউনুচ আলী। এদিকে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, দুপুরের পরেই আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি ৬৯টি কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় সীল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। এ সহ শতাধিক কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আ্ওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির আরেকটি নমুনা জাতি দেখতে পেল। অপরদিকে আ্ওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক দাবি করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিুপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। বিকেল চার টায় ভোট গ্রহণ শেষে ফলাফল গণনা শুরু হয়।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে নগরীর জিলা স্কুল কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট আলী আকবরকে মারধর করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর সমর্থকরা। পরে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখান থেকে তাকে অপহরণ করে ছবি ফিসে নিয়ে য্ওায়া হয়। পরে দুই ঘন্টা পর আবার তাকে আওয়ামী লীগের এক নেতার মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়।

এ ছাড়া একই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর ছোট ভাই কাজী বেলায়েত হোসেন নতুন বাজার হাজী আবু হানিফ কেরাতুল কোরআন নূরানী মাদরাসা কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেননি। খুলনা জিলা স্কুল কেন্দ্রের আটটি বুথেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেয়নি। এ সব কারণে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট বাতিলের লিখিত আবেদন করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মাহবুব কায়সার। মঙ্গলবার ভোটের দিন দুপুরে কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুস আলীর কাছে বিএনপি সমর্থিত এই কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ দাখিল করেন।
বেলা ৩টার দিকে নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে আ্ওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলী করে কেন্দ্র দখল করে নেয় বলে স্থানীয়রা জানান। এরপর তারা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে ছিল মেরে বাক্সে ঢোকান। এ ঘটনায় সাড়ে তিনটার দিকে ভোটগ্রহণ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।

নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২০৫ নম্বর ভোটকেন্দ্র সোনাপোতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের ভোটকক্ষে বসে সিগারেট খেতে দেখা যায়। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় তারা ফিরে যায়। কিছু সময় পরে তারা এসে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়।’ ঢাকা থেকে আসা একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিককেও ২৪নং ওয়ার্ড নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা জালভোট দিতে অনুরোধ জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সাংবাদিক এ তথ্য জানান।
নগরীর খালিশপুর থানার ১১নং ওয়ার্ডে জামিয়াহ তৈয়্যেবাহ নূরানী তালিমুল কোরআন মাদরাসা কেন্দ্র থেকে সহোদর সিরাজকে কুপিয়ে আহত এবং আলমকে মারধর করা হয়। তাদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে দুপুর ২টার দিকে নৌকা প্রতীকের লোকজন প্রকাশ্যে সীল মারে। এ ছাড়া এ ওয়ার্ডে জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম বয়স্ক মাদরাসা কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জামান মোল্লা জেলিনের এজেন্ট আসাদ ও হাবিবকে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। বেলা ২টা থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত ভোটার ছাড়া অন্য কোন ভোটারকে নগরীর ১১ নং ওয়ার্ডের প্লাটিনাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তারা কেন্দ্রে ঢুকে এক একজন ৪/৫টি করে ভোট দিয়ে বের হয়ে এসেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
১০ নং ওয়ার্ডের বঙ্গবাসী ও মওলানা ভাসানী স্কুল কেন্দ্রটি দুপুরের পর থেকে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ধানের শীষের প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সীল মারে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-২৩৭ নম্বর কেন্দ্র পরির্দশনের সময় এ অভিযোগ করেন বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহেদি রেজভী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন অভিযোগ করেন ‘প্রতিপক্ষরা তাদের কর্মীদের ভোট দিতে দিচ্ছে না। আগে থেকেই ব্যালটে সিল মেরে তা বক্সে ফেলছে। অনেক ভোটার এসেই বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছেন।’
অভিযোগ করার সময় নৌকা সমর্থিত একদল যুবক তাদের ঘিরে হইচই শুরু করে। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘এরা মিথ্যুক। সবাই তাদের ভোট দিয়েছেন।’
এসময় ভোটার আব্দুস সাত্তার (৫০) সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘আমি ভোট দিতে বুথে গেলে তারা পাশের রুমে যেতে বলে। সেখানে গেলে জানানো হয়, আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, ব্যালটও শেষ। বাড়ি চলে যান!

এই কেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন ইন্সপেক্টর তোফায়েল। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও সরকার বিরোধীরা এমন অভিযোগ করেই থাকে। ভোট সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে।’
কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহদী রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী প্রার্থীর লোকের নৌকায় সিল দিচ্ছে।’ একই অভিযোগ করে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন বলেন,‘অভিযোগ করায় আমাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট কারচুপি হচ্ছে। তা নিয়ে আমাদের কোনও কথাও বলতে দেয়া হচ্ছে না।’
নগরীর বেলা ১১টার সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা উজ্বল কুমার পাল একটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে বাধা দেয়ার পর তাকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোট শেষে বাড়ি ফিরলে কী হয় এ নিয়ে তিনি শঙ্কিত।

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ৫/৭ জন লোক এসে ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়। পরে তারা নৌকায় সিল মারতে গেলে আমি তাতে বাধা দিয়েছি। এমনকি আমি সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বক্সে ভরতে দেইনি।’ ‘তারা আমার নাম পরিচয় জেনে গেছে। ভোট শেষ হলে দেখে নেবে বলেছে। আপনাদের মিডিয়ার ভাইদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার কাছে থাকা একশ’ ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যার সিরিয়াল নং ০০৪৫৮৪০১ থেকে ০০৪৫৮৫০১ পর্যন্ত। সেগুলো সিল মেরে বাক্সে দিতে দেইনি। আমি তাদের বাধা দিলে তারা আমাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে।’ এই ঘটনার পর এই কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবারও ভোট গ্রহণ করা হয়। পাশেই আরও একটি কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর সেটিও দুই ঘন্টা ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়।
নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজে জাল ভোট দেয়ার সময় দুইজনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু আটককৃতদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের এসআই বোরহান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, অসহায়। আপনাদেরই ভাই ব্রাদার। নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে। এ সময় নির্বাচনী দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সে কেন্দ্রে গেলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।

বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত সমন্বয়ক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্যই তাদের তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। এদিকে জাল ভোট দেয়ার সময় সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যম সেখানে পৌঁছার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের কয়েকটি গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা ভোট দিতে আসছেন তাদেরও ফেরত দেয়া হয়েছে ব্যালটের অভাবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা অনুযায়ী ব্যালট সরবরাহ করা হলেও এ কেন্দ্রে দুপুর একটার সময়ই শেষ হয়ে যায় ব্যালট পেপার। একই রকম পরিস্থিতি নগরীর শেরে বাংলা রোড সোনাপোতা স্কুল কেন্দ্রে। সেখানেও দুপুর দেড়টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সব ব্যালট পেপার। সকালে এ কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি প্রার্থীর টেন্ট এর চেয়ার টেবিল ভাংচুর করা হয়েছিল।
৩১ নং ওয়ার্ডের লবণচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের পাশাপাশি প্রিজাইডিং অফিসারদেরও বের করে দেয় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের সমর্থকরা। তারা বুথের ভেতরে ঢুকে যখন সীল মারছিলো তখন প্রিজাইডিং অফিসাররা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা সাংবাদিকদের বলেন, তাদের বুথ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
২০ নং ওয়ার্ডে এইচ আর এইচ প্রিন্স আগাখান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোটারদেরকে বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সীল মারে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

৪ নং ওয়ার্ডে দেয়ানা উত্তর পাড়া কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বিএনপি কর্মী মিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৯ নং ওয়ার্ড ইসলামাবাদ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে মারধর করে প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। পাইওনিয়ার স্কুল ভোটকেন্দ্র থেকেও প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয়া হয়েছে বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরকে। গল্লামারি লায়ন্স স্কুল ও নিরালয় স্কুল কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টকে প্রশাসনের সামনে মারধর করে বের করে দেয়া হয়।

দুপুর দেড়টার দিকে কেএমপির সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ১৪ নং ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন স্কুল কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় একযোগে প্রকাশ্যে নৌকা ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকে ছিল মারতে দেখা যায় বলে বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করেন। এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মাহবুবুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন-এ কেন্দ্রে প্রতিটি বুথ থেকে একশ’টির মতো ব্যালটে সন্ত্রাসীরা সীল মারে।

বেলা ৩টার দিকে নগরীর ১৬ নং ওয়ার্ডের নূর নগর নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা নির্ধারিত সময় শেষ হ্ওয়ার পরেও নৌকা প্রতীকে সীল মারতে দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। খবর পেয়ে র্যা বের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তারা পালিয়ে যায়। এর আগে সকালে এসব কেন্দ্রে কোন এজেন্টকে ঢুকতে দেয়নি। এমনটি অনেক সতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের এ কেন্দ্র ছাড়াও আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্নুজান স্কুল কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সকাল ৯টা থেকে ৯ নং ওয়ার্ডের বৈকালী ইউসেফ স্কুল কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

এদিকে কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে ব্যালট সংকটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় ভোটারদের পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও এই অভিযোগ করেন। তবে ব্যালট সংকটের কারণ জানাতে পারেননি নির্বাচন কর্মকর্তারা। বিএনপির সহকারী দফতর সম্পাদক শামসুজ্জামান চঞ্চল অভিযোগ করেন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিরালা স্কুল কেন্দ্রে দুপুর ১২টার পরই ব্যালট শেষ হয়ে গেছে। দুপুর ১টার দিকে নগরীর ৪ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ দেয়ালা স্কুল কেন্দ্র আ্ওয়ামী লীগ সমর্থকরা দখল করে নেয়। পরে তারা প্রশাসনের সামনে নৌকা প্রতীকে সীল মারে। ১৪ নং ওয়ার্ডের কাজী আব্দুল বারী স্কুলে ঢুকে দুপুর ২টার দিকে আ্ওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতীকে সীল মারে।

তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত : কেসিসি নির্বাচনে জোরপূর্বক ব্যালটে সিল মারার কারণে দু’টি ভোটকেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এগুলো হলো-ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র (পুরুষ) ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ও লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। দুপুর ১২টার দিকে ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের (পুরুষ) ভোট স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আর বেলা দুইটার দিকে অপর কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়।
ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কেন্দ্রে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক জোর করে ঢুকে পড়েন। তাঁরা কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মেরে ভোট বাক্স ভরতে থাকে। এই ঘটনার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের ঘোষণা দেন।
কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুধের ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট কাকলী খান ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জাকিয়া সুলতানার এজেন্ট সাজেদা খাতুন বলেন, ওই যুবকদের সবার শার্টে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। তাঁরা এসেই অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের গ্লাস প্রতীকে ভোট দিয়ে তা বাক্সে ভরেন।
এ সময় প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেছে কি না, সেটা তাঁর জানা নেই।

প্রিজাইডিং কর্মকর্তার পাশেই ছিলেন ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর পোশাকে নামের কোনো ব্যাজ ছিল না। ব্যাজ কোথাও পড়ে গেছে জানিয়ে নিজের নাম নয়ন মিয়া বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র যে দখল হয়েছে, এমন তথ্য তাঁদের কাছে ছিল না।
এরপর দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রে আসেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই কেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে। সব ব্যালট পেপার জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে মারধর করা হলে সেটা পুলিশের ব্যাপার।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ‘ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়’ কেন্দ্রে একদল যুবক ঢুকে ব্যালটে সিল মারতে থাকেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলের নির্বাচনী প্রতীকে টিফিন ক্যারিয়ারে সিল মারতে থাকেন। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১ হাজার ৬৯১ জন। প্রায় আধা ঘণ্টা তাঁরা ব্যালটে সিল মারেন। এরপর পুলিশ এলে তারা চলে যান।

ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আলীম হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা ব্যালটে সিল মারলেও তা বাক্সে ভরতে পারেনি। পরে দুটার দিকে কেন্দ্র স্থগিত করা হয়। এদিকে দুপুরে আমরা ৩১ নং ওয়ার্ডের শিশুমেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঐ ওয়ার্ডের আ্ওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলকে। সে সাংবাদিকদের দেখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বাইরে আসলে জানা যায়, সাংবাদিকদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালককে সাশিয়ে যায় রাসেলের ক্যাডাররা। তারা বলে-’রাসেল ভাই ছালাম দিয়েছে, আপনারা দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যান।

অপরদিকে এ নির্বাচনে দুটি মাত্র কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট নেয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ভোট দেয়া নিয়ে নারী ভোটারা খুশি হলে পুরুষ ভোটারা নাখোশ। অন্যদিকে নগরীর পিটিআই কেন্দ্রে পুরুষ ভোটারা ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে ভোট দিতে গিয়ে পুরুষ ভোটারা অসন্তোষ। তারা বলেন এ পদ্ধতিতে ভোট দিতে সময় বেশি লাগছে, ফলে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পূর্ববানিয়া খামার এলাকার সুমন হোসেন ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘ইভিএম পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগে। তাই আমাদের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। আঙুলের ছাপ না মেলায় বার বার চেষ্ট করা হচ্ছে। এ কারণে সময় বেশি লাগছে। ’
একই এলাকা থেকে আসা প্রদীপ জানান, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। আমার আগুলের ছাপ না মিলায় আবার বাসায় গিয়ে ন্যাশনাল আইডি কার্ড আনতে হয়েছে। আমার কাছে ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়াই সহজ মনে হয়।
পিটিআই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. মামুন সরদার বলেন, ‘নতুন পদ্ধতি এ কারণে ভোটারদের বুঝতে সময় লাগছে। দুই ঘণ্টায় তিনশ’ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কেন্দ্র দুটোতেই সকালে ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ছে।

ইভিএম কেন্দ্রের ফলাফল, আওয়ামী লীগ ৭৭৭, বিএনপি ৭১০ ভোট : কেসিসি নির্বাচনে দু’টি কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুইটি কেন্দ্রেরই ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। নগরীর পিটিআই জসিম উদ্দিন হোস্টেলের নীচতলা ইভিএম কেন্দ্রের ঘোষিত ফলাফলে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ৫০৫ এবং বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন ৫১১ ভোট। অপর ২৪ নং ওয়ার্ডের সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ২৭২ এবং বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছেন ১৯৯ ভোট। এ দু’টি কেন্দ্রের মোট ফলাফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছেন ৭৭৭ ভোট এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছেন ৭১০ ভোট।
উল্লেখ্য, খুলনা সিটি কর্পোরেশনে প্রথমবারের মতো মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার মেয়র পদে ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক (নৌকা), বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী শফিকুর রহমান মুশফিক (লাঙল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক (হাত পাখা) ও সিপিবি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান বাবু (কাস্তে) প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়ছেন। এছাড়া নগরীর ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ১৪৮ জন এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবারের নির্বাচনে খুলনা সিটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৬ ও নারী ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন। এ নির্বাচনে ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রে রয়েছে ২৩৪টি এবং ৫৫টি সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এবার ভোট কক্ষ রয়েছে ১ হাজার ৫৬১টি। আর অস্থায়ী ভোট কক্ষ ৫৫টি। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার ছিলেন ৪ হাজার ৯৭২ জন।

http://www.dailysangram.com/post/330636