যমুনার বুকে চর জেগে ওঠায় ক্ষীণ হয়েছে পানির ধারা। ছবিটি সিরাজগঞ্জের চৌহালী থেকে তোলা : নয়া দিগন্ত
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৯

তিস্তার মূল প্রবাহের ৮০ শতাংশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত: যমুনার পেটে অসংখ্য চর জেগে সঙ্কুচিত হয়েছে নৌপথ

ভারত তিস্তার উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে ৮০ শতাংশের বেশি পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে ভাটির বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০০ কিউসেকে। তিস্তার পেটে এখন ধু-ধু বালু চর। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী যমুনা মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। যমুনার প্রবাহ কমে যাওয়ায় সঙ্কুচিত হয়েছে নৌপথ। যমুনা সংযুক্ত ২০টি শাখা-উপশাখা নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। কমেছে মাছ ও জলজ প্রাণী। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি অর্থনীতি ও জলবাযুর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনার পেটে এখন দৃশ্যমান অসংখ্য বড় বড় চর।
ভারত গজলডোবায় তিস্তার ওপর যে ব্যারাজ নির্মাণ করেছে তার ফলে তিস্তার ভারতীয় অংশে পানি থৈ থৈ করছে। আর ভাটির বাংলাদেশ অংশ এখন ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। তিস্তার পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি ‘তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল’-এর সাহায্যে শুকনো মওসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে ১৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১০টি। এই সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদাহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ খালটির মধ্যে করলা, নিম, সাহু, করতোয়া ও জোড়াপানি নদী রয়েছে। এসব নদীর ওপর অ্যাকুইডাক্ট (কৃত্রিম পানিপ্রণালী) তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক কারিগরিতে তৈরি অ্যাকুইডাক্টের নিচে বয়ে চলেছে নদী, ওপর দিয়ে খাল। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি রুপি।
এ দিকে মহানন্দা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৩টি। ডাউক নগর প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৮টি। নাগর টাঙ্গন প্রধান খালের দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে বছরে এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের খংখ্যা আটটি। তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ছয়টি। ভারত তিস্তার মূল প্রবাহের ১৬ আনা পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তার প্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০০ কিউসেকে।
বিআইডব্লিউটিএ’র আরিচা অফিসের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৫ বছর আগে যমুনা ও তিস্তা নদী দিয়ে যেসব কার্গো জাহাজ চলত এখন আর সেই বিশাল কার্গো জাহাজগুলো চলতে পারে না। আগে যেখানে ১২ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলত এখন সেখানে ৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারে। ২৫ বছর আগের চেয়ে এখন নৌপথ কমে অর্ধেক হয়েছে। তিস্তাপ্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনা হয়ে তিস্তায় আর কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইনুন নিশাত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজে উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্য। আসল কথা হলো, তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত ১৬ আনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা কোনো সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয়। এটা পুরোপুরি অনৈতিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এ নদী শুধু পানি নয় প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি নিয়ে আসে। তিস্তা উত্তরাঞ্চলের সেচকাজ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উদ্ভিদরাজি ও পুরো ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। ভৌগোলিকভাবে তিস্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরের জলাধারে পুনঃসরবরাহের জন্য তিস্তার পানি একান্ত প্রয়োজন। তিস্তার পানি কমে গেলে এ এলাকার অন্যান্য ছোট নদীও শুকিয়ে যাবে। এ জন্য তিস্তার পানির সরবরাহ বাংলাদেশের বাস্তব ব্যবস্থার জন্য, মৃত্তিকার উর্বরতার জন্য ও জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন। তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেয়া অনৈতিক।
ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ সমীক্ষাভিত্তিক ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ নিরাপদ পানিবঞ্চিত। এ সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। বাংলাদেশের বড় নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে প্রতিবেশী দেশ পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় নদী অববাহিকায় সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের নদী অববাহিকায় খাাওয়ার পানির তীব্র সঙ্কট চলছে। ভারত সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোতাবেক এ নদীর ওপর ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব বাঁধ প্রকল্প পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচসুবিধা বৃদ্ধি করবে। প্রকল্পগুলোর জন্য মূল ব্রহ্মপুত্র নদে ও এর শাখা নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ এবং ব্যাপকহারে পানি প্রত্যাহার করতে হবে। তিস্তার ভারত অংশের একেবারে ভাটিতে বাংলাদেশের কাছে ব্যারাজ নির্মাণ ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার ৯ লাখ হেক্টরের বেশি জমি সেচের আওতায় আনার বিশাল পরিকল্পনা আছে। এই প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের বেলায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। ভারত তিস্তা নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করায় শুধু তিস্তার প্রবাহই ব্যাপক হারে কমে যায়নি, যমুনা নদীতে তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কারণ যমুনার অর্ধেকের বেশি পানি তিস্তা থেকে আসে। ইতোমধ্যে যমুনা নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। আর নদীর পেট ভরাট হয়ে বিশাল বিশাল চর পড়েছে। প্রশস্ত যমুনা এখন ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিস্তার উজানে ভারত ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে ফেলেছে। আরো প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় তিস্তার ভাটিতে পানির প্রবাহ আরো কমবে। বাংলাদেশ অংশে বাড়বে সঙ্কট। তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমার কারণে বাংলাদেশ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ যমুনা নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাবে। রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। অন্য দিকে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়েছে। সেচ প্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমে পানির তীব্র সঙ্কট বিরাজ করে। এ কারণে গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।
ভারত ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে টিপাইমুখসহ ১২টি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে চারটি, বাস্তবায়নাধীন রয়েছে তিনটি ও পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরো পাঁচটি। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। রিভারলিংকিং প্রজেক্টে ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে ভারত যেসব প্রকল্প গড়ে তুলেছে তার বেশির ভাগই হচ্ছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দু’টি অববাহিকায় পানির ৩৩টি জলাধার নির্মাণ করবে। প্রতিটি জলাধারের পানি ধারণক্ষমতা হবে এক লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। ভারত গঙ্গায় বহুসংখ্যক বাঁধ নির্মাণ করে উত্তরখণ্ড, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচ প্রকল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো: সরওয়ার জাহান সজল বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ কমে আসবে। শুকনো মওসুমে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পানির উৎস। এই নদ দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। ভারত চাইলেই একতরফা যৌথ নদীর ওপর এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। পানি সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা যাবে না। নেপালে জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কার পানিপ্রবাহ এক লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে এক লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে সবাই লাভবান হবে।।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুন নেছা বলেন, ভারত কোনো বিশেষ এলাকার মানুষের ক্ষতির চেয়ে সাময়িক লাভালাভকেই অগ্রাধিকার দিতে চায়। এখনই বিদ্যুৎ চাই, সেচের পানি চাই, এই চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও তারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে প্রতিবেশী দেশের কোনো বিপর্যয়কে তারা আমলে নিতে চায় না। গঙ্গার পানি বণ্টনের সাথে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয়ও আলোচনাভুক্ত করতে হবে।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/195732