১৬ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:০৯

মালয়েশিয়ার নির্বাচন ও রাজনীতির শিক্ষা

জি কে সাদিক

গত ৯ মে মালয়েশিয়ার ১৪তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের ২২২টি আসনে এবং ১৩ রাজ্যের মধ্যে ১২ রাজ্যের ৫০৫টি আসনে দুই হাজার ৩৩৩ জন প্রার্থী নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেড় কোটি ভোটারের মধ্যে ৭৬ শতাংশ ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতার পর থেকে ৬০ বছর ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছে হারাপান পাকাতান জোট। ২০১৫ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে বিনিয়োগ তহবিলের ৭০ কোটি ডলার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে রাজনৈতিক শিষ্য রাজাকের বিরোধী মোর্চা হারাপানে যোগ দেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদ। নাজিব রাজাক ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বারিসান ন্যাশনাল পার্টির সরকারের। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পতন ও নাজিবের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ যোগ দেন বিরোধী শিবিরে, আর তখন থেকেই মালয়েশিয়াতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। ১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মালয়েশিয়াও ছিল তৃতীয় বিশ্বে; কিন্তু আজ আর তাদের সে অবস্থান নেই। আজকের যে মালয়েশিয়া এ অবস্থানে এসেছিল মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরেই।
২.
তিনটি সালতানাত ও ১৩টি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত তিন লাখ ২৯ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া। জনসংখ্যা তিন কোটি ২০ লাখ। রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান। ১৯৫৭ সালে মালয়ীদের দলগুলোর সম্মিলিত ফোরাম জয়লাভ করলে ব্রিটিশ সরকার তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং সে সময় থেকেই মালয়েশিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ। আর তখন থেকে মালয়েশিয়ার সরকার ও রাজনীতিতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। রাষ্ট্রের স্বার্থই মালয়েশিয়ার অর্থনীতির মূলমন্ত্র। মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা হচ্ছে মালয়। এ ছাড়াও ১৩০টি ভাষা প্রচলিত আছে। মালয়েশিয়াতে ভাষা ও অঞ্চলকেন্দ্রিক অনেক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বসবাস করে। এখানে মালয়ী ৫০.১ শতাংশ, চায়নিজ ২২.৫ শতাংশ, আদিবাসী ১১.৮ শতাংশ, ভারতীয় ৬.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ৮.৮ শতাংশ মানুষ বাস করে। তথাপি ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ নেই। মালয়েশিয়াতে শরিয়া আইনের পাশাপাশি সিভিল কোর্টও রয়েছে। সাধারণত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য শরিয়া আইনের প্রচলন। যদি কেউ চায়, সাধারণ আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে। মালয়েশিয়া সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক ধর্মের সম-অধিকার নিশ্চিত করেছে। তাই জাতীয়ভাবে সরকার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করতে চাইলে ইসলামি গবেষকেরা এ ব্যাপারে সতর্কতার সাথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। মুসলিম ৬১.৩, খ্রিষ্টান ৯.২, বৌদ্ধ ১৯.৮, হিন্দু ৬.৩, কনফুসিয়াস ১.৩ এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ১.২ শতাংশ। এমন ধর্মবৈচিত্র্যের দেশে সম্পূর্ণভাবে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন কঠিন বটে।
মালয়েশিয়া নানা রকম চড়াই-উতরাই পার করে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। এর পেছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ১৯৬৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬৯ সালের ৩০ মে কুয়ালালামপুরে চীনা-মালয়ী দাঙ্গার সময় মাহাথির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমানকে সমালোচনা করে চিঠি লেখার কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৭২ সালে সে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পুনর্বহাল করা হয়। ১৯৭৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলে শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৭৬ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে প্রণীত নিউ ইকোনমিক পলিসির (এনইপি) সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির ভাগ্যে জাদুকরি উন্নয়নের পরশ এনে দেন। ১৯৯০ সালে মালয়েশিয়ার বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হওয়ার পর তিনি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (এনডিপি) হাতে নেন। বিশ্বব্যাংকের কোনো ধরনের সাহায্য গ্রহণ না করে তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ কিভাবে উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছতে পারে, সে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। ২০১৩ সালে নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সে উন্নয়নে কিছুটা ভাটা পড়ে। তাই দেশের স্বার্থে আবারো রাজনীতিতে আসেন মাহাথির মোহাম্মদ। ১৪তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন গত ১০ মে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর ক্ষমতায় থাকবেন। এরপর তিনি দীর্ঘ দিন কারাবন্দী বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের মুক্তির ব্যবস্থা করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৩.
মালয়েশিয়াতে নির্বাচন হলো, কিন্তু কোনো রক্তপাত হয়নি। সিলমারা, ভোট কারচুপি, ব্যালটবক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল বা বিরোধীদলীয় এজেন্টকে বের করে দেয়ার অভিযোগ ওঠেনি। তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ কিভাবে অর্থনৈতিক সক্ষমতায় বিশ্বের কাছে রোল মডেলে পরিণত হলো এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এতটা স্থিতিশীলতা কিভাবে এলো, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটা দেশের জন্য। মালয়েশিয়া ধর্ম, ভাষা ও জাতিগতভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ একটা দেশ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং সে দেশে ইসলামি আইনও আছে। তবুও সব দিক থেকেই উন্নত। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকার পরও ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই। একসময় মালয়েশিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে এসেছে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য। আজ তার উল্টো। ১৯৫৭ সালে মালয় ফেডারেশন গঠনের পর ইসলামি শিক্ষার প্রসারকল্পে প্রধামন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমান ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল সদ্য-স্বাধীন মালয় ফেডারেশনকে নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা ও পুনঃগঠন করা। বিচক্ষণ মাহাথির ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, ‘আমাকে ১০ জন যুবক দেয়া হলে আমি জনগণকে সাথে নিয়ে বিশ্বটা জয় করে ফেলব।’ জয় করেছিলেনও বটে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেন মালয়েশীয় নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কুষ্টিয়া
ই-মেইল : sadikiu099@gmail.com

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/318818