১৬ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:০৮

একটি ‘অক্ষত’ লেগুনার কাহিনী

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ কাহিনী নতুন নয়। দেশে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। যেমন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে আগুন দিয়েছেন সে কারণে সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী মাসের পর মাস সরকারের জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়ে এটা একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ঢাকা পেরিয়ে দেশের দূর-দূরান্তে গ্রামগঞ্জে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা চরম হয়রানির শিকার হয়েছে। বহু এলাকায় রাতের পর রাত এই নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারেনি। মধ্য রাতে পুলিশ হানা দিয়েছে। দৃশ্যত কোনো অপরাধ নেই। অপরাধ তারা সরকারি দল করে না। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বনে-বাদাড়ে, কৃষি জমিতে ঘুমিয়েছে। সে ধারার এখনও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিরোধীদল দলনে সরকার বরাবরের মতোই নির্লজ্জ আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে সরকার যা করল তাতে ধরে নিতে হয় যে, তারা এই দুই সিটিতে পরাজয় মেনে নিয়েছে। এখন স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় বিরোধীদলকে দমন করতে চাইছে।

তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। গাজীপুরে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার আগে সেখানে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সরকারি দল ও বিরোধীদল মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছিল, তখনই এলো এই লেগুনার কাহিনী। এক লেগুনায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করেছেন, এমন অভিযোগ এনে পুলিশ ১০৩ জন নেতাকর্মীর নামসহ ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। যে লেগুনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগে পুলিশ গাজীপুরের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দায়ের করেছে, সেটি অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে টঙ্গী থানা প্রাঙ্গণে। আর মামলার আসামীদের অধিকাংশই গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের নিটক আত্মীয় ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি। বিএনপি বলেছে, তাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে পুলিশ এই মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বেছে বেছে নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত নেতাদের আসামী করেছে। যাতে পরে নির্বাচন করে ফাঁকা মাঠে সুবিধা নিতে পারে সরকারি দল।

গত ৬ মে আদালতের নির্দেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতের দেড় ঘন্টার মধ্যেই পুলিশ হাসান সরকারের বাড়ির আশপাশে অভিযান চালিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে আটক করে। ৬ ঘন্টা পর নোমানকে ছেড়ে দেয়া হয়, বাকি ১২ জনসহ ১০৩ জনের নাম উল্লেখ করে পরদিন ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে টঙ্গী থানায় মামলা করে পুলিশ। এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি আছে আরও প্রায় দেড়শ জন। অর্থাৎ প্রয়োজনে বিএনপির নির্বাচনের সাথে যুক্ত যে কাউকে আটক বা হয়রানি করা যাবে। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৪৮ জনই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আছেন। এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ইচ্ছা করেই পুলিশ এই ধরনের মামলা করে থাকে। আসামিদের হয়রানি করা হবে, টাকা আদায় করা হবে। পরে নির্বাচন হলেও নেতাকর্মীদের পালিয়ে থাকতে হবে।
এই মামলায় যে ঘটনাস্থলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটাও হাসান সরকারের বাড়ি থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্টার হেভেন রেস্তোরাঁর সামনে। ঘটনার সময় বলা হয় ৬ তারিখ বিকেল সাড়ে চারটা। আর মামলা দায়ের হয় ৭ তারিখ বিকেল ৬টা দশ মিনিটে। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে একটি লেগুনা গাড়ি, তার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-১১-৬০৮০। কাচের টুকরা ও দশটি ইটের টুকরা। মামলায় বলা হয়, ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আরও একশ’ থেকে দেড়শ’ নেতাকর্মী পুলিশ দেখে পালিয়ে যায়। তারা একটি লেগুনা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি করেছে।

কিন্তু গত ৮ তারিখ বিকেল চারটায় মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা গাড়িটি অক্ষত অবস্থায় থানায় দেখা গেছে। তাতে ভাংচুর বা অগ্নিসংযোগের কোনো আলামত দেখা যায়নি। লেগুনার ভেতরে বসেছিলেন গাড়িটির মালিক গাজীপুরের কামারিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আলামিন। তিনি একটি সংবাদপত্রকে বলেন যে, ৬ মে বেলা পৌনে তিনটায় লেগুনাটির রিকুইজিশন করে পুলিশ। সাড়ে তিনটার দিকে টঙ্গীর চেরাগ আলী থেকে তিনজনকে আটক করে ঐ গাড়িতে তোলা হয়। থানার দিকে যাওয়ার পথে গাড়ি নষ্ট হওয়ায় পুলিশ অন্য গাড়ি নিয়ে চলে যায়। গাড়িটি ঠিক করে ফেরার পথে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে থানার সামনে থেকে আবার গাড়িটি আটক করে থানার ভেতরে নিয়ে যায় পুলিশ। গাড়ির চালক রকিবও একই বিবরণ দিয়েছেন। গাড়িতে আগুন দেয়া বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি বলে তারা দু’জনই নিশ্চত করেছেন।

মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব কাজী ছাইয়েদুল আলম, বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচন পরিচলনা কমিটির গণমাধ্যম কর্মকর্তা মজহারুল আলম, গাজীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ইজাদুর রহমান। আসামি করা হয়েছে বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের চার চাচাতো ভাই সালাউদ্দিন সরকার, পাপ্পু সরকার, নকিবুদ্দিন সরকার ও অপু সরকারকেও। সালাউদ্দিন সরকার টঙ্গী অঞ্চলের বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক। হাসান সরকারের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মামুন সরকার, ফুফাতো ভাই টঙ্গী পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক বশির ও মামাতো ভাই নবীনও আসামি। এ ছাড়া ৭ থেকে ১২ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে কোনাবাড়ি ইউনিটের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস সরকার, ১৯ থেকে ২৩ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে কাউন্তিয়া ইউনিটের দায়িত্বে থাকা নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান, ১৩ থেকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সুরুজ, ২৩ থেকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে গাছা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা হাজী সামাদ ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নাসির উদ্দিনকে আসামী করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডের একাধিক কাউন্সিলর, বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনকেও আসামী করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আছে তথ্যের গরমিল। সালাহউদ্দিন সরকার ও তার ভাতিজা মামুন সরকারকে আসামী করা হয়েছে। কিন্তু তাদের পিতার নাম লেখা হয়েছে একই। এ ছাড়া রয়েছে নির্বাচিত কাউন্সিলর ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থী অনেকের নাম, যা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে গাজীপুরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, নির্বাচন স্থগিত হওয়ার খবর পেয়ে ঐ দিন তার বাড়ি ও কলেজগেট এলাকায় জড়ো হয়েছিলেন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু কোনো ভাঙচূর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। আমাকে কর্মী-সমর্থকশূন্য করে খালি মাঠে নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে গণগ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এই মামলা বিষয়ে টঙ্গি থানার ওসি দাবি করেন, কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়েছে। থানা থেকে লেগুনাটি ছাড়িয়ে নিতে তার মালিক মিথ্যা কথা বলছেন। এ বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘দেশে বহু বছর ধরেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। বিভিন্ন সময় হাইকোর্টের রায়েও এটা প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনীতির মাঠে বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে আইনটির নগ্নতা প্রদর্শন ও অপব্যবহার।’ তিনি বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এ ধরনের মামলাকে নির্বাচনে পরাজয় ঠেকাবার কৌশল হিসেবে দেখতে পারে জনগণ।
তবে থানায় আটক অক্ষত লেগুনাটি মুখ ব্যাদান করে দেখিয়ে দিল যে, সরকার নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নেবার জন্য পুলিশ বাহিনীকে এমন নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে। তবে কি সরকারের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একেবারে ভরাডুবি হবে। আর তাই বলপ্রয়োগ আর পুলিশী অত্যাচারের মাধ্যমে জেতার এমন প্রাণান্ত চেষ্টা। উন্নয়নের তুবড়ি ফোটানো, দুর্নীতির স্রোতে ভাসা এই সরকার যদি নিশ্চিত হতে পারতো যে, জনগণ তাদের ভোট দেবেই। তা হলে তাদেরকে এই পুলিশি সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে হতো না। আর এ থেকেই প্রমাণিত হয়, সরকারের জনসমর্থন একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেছে।

এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও রহস্যজনক। অক্ষত লেগুনার ছবিসহ এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশের পরও কোনো ভূমিকা পালন করেনি। সংশ্লিষ্ট ওসিকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দেয়নি। অথচ নির্বাচন কমিশনের কাছে সেটাই প্রার্থিত ছিল। আবার মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই, যারা নির্বচনি দায়িত্বে রয়েছেন। ইসি এমন বিধিবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। এর ফলে এটা মনে করা খুব স্বাভাবিক যে, সরকার যেভাবে চায় নির্বাচন কমিশন ঠিক সেভাবেই এই নির্বাচনটি পরিচালনা করতে আগ্রহী। তার বাইরে কোনো কথা শুনতে তারা প্রস্তুত নয়। এর চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে খুলনায়। সেখানে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের পুলিশ পাইকারিহারে গ্রেফতার করছে। প্রথম থেকেই পুলিশের এই আচরণের বিরুদ্ধে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং মেয়র প্রার্থী মঞ্জু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তারা বারবার এর বিরুদ্ধে ইসির কাছে প্রতিকার দাবি করেছেন। কিন্তু ফায়দা হয়নি কোনোই। এখনও গণগ্রেফতার চলছে, মধ্য রাতে বিএনপি নেতাকর্মী, সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ হানা দিচ্ছে। এভাবে খুলনায় এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে পুলিশ। নির্বাচন কমিশন নিশ্চল নিশ্চুপ আছে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সেখানকার রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় এবং রিটার্নিং অফিসারের উপরে একজন যুগ্মসচিবকে দায়িত্ব দেয়ার দাবি করা হয়। যা নির্বাচনী বিধির সম্পূর্ণই লঙ্ঘন। কারণ, ইসির দায়িত্ব পালনে প্রধান কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার। তার উপরে খবরদারি করার এখতিয়ার কারো নেই। যদি রিটার্নিং অফিসারের প্রতি অনাস্থাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়, তাহলে অন্য কোনো ব্যক্তিকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারতো। তার উপরে কাউকে বসানো হতো না। এটি নির্বচনী বিধির চরম লঙ্ঘন। অথচ নির্বাচন কমিশন নির্বিকারভাবে এই লঙ্ঘনের কাজটি করেছে।

অর্থাৎ সরকারি হিসাবের বাইরে এক কদমও ফেলতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে ততক্ষণে খুলনার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে আর সম্ভবত ফলাফলও জানা যাবে। কিন্তু যে আভাস এখানে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে জাতীয় নির্বাচন করা দুরূহই থেকে যাবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/330587