১৪ মে ২০১৮, সোমবার, ১০:১১

দেশপ্রেমের চশমা

নির্বাচনকালীনে নয় সমাধান নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারে

একাদশ সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, কেমন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হবে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজে ততই আলোচনা বাড়ছে।
এ আলোচনায় আন্তর্জাতিক মহল এবং ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরাও সম্পৃক্ত। এ দেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে তারাও বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচন ভালো হবে কিনা, সে আলোচনা মূলত শুরু হয়েছে ২০১০ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার লক্ষ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়। অবশ্য তারও আগে ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে এমন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও ওই সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না।
কারণ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগে বাংলাদেশ সংবিধানে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলে কিছু ছিল না। কাজেই সাহাবুদ্দীন সরকারের অধীনে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পঞ্চম সংসদ নির্বাচন করেছিল, সে সরকারটি ছিল সব দলের সমর্থিত একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকার এবং এর পরের সাংবিধানিক ভিত্তিমূলক দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার (বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত) যে সংসদ নির্বাচনগুলো করেছিল, ওই নির্বাচনগুলো ভালো এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি ও রুগ্ন গণতন্ত্রকে সুস্থ করার লক্ষ্য নিয়েই এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ওই সময় রাজনৈতিক নেতারা ভেবেছিলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে অসুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং এক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক সুস্থতা অর্জিত হলে তখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না। ওই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চায় পরিবর্তন আনবে এবং গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে তুলবে। এ কারণেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন তিন জোটের রূপরেখায় (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ এবং বামদলগুলোর জোটভুক্ত ৫ দল) এমন প্রত্যাশা করা হলেও ঠিক কয়টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আবার দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন শুরু হবে এমন কোনো লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এজন্য ধরে নেয়া যায়, যে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, যতদিন সে উদ্দেশ্য পূরণ না হবে, ততদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন হতে থাকবে। বিষয়টি অনেকটা এ রকম- রোগীর অসুখ হওয়ায় তাকে ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বলেছেন, ততদিন পর্যন্ত এ ওষুধ খেতে হবে যতদিন তার রোগটি না সারে।
কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসুস্থ গণতন্ত্রের চিকিৎসায় মনোযোগ দেয়নি। সে কারণে গণতান্ত্রিক অসুস্থতা আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর অশিক্ষিত বোকা রোগীর মতো দলীয় ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে তিনদলীয় জোটের রূপরেখার প্রেসক্রিপশন অবজ্ঞা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সুস্থতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রদত্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা বন্ধ করে মারাÍক নির্বাচনী বিপর্যয় ডেকে আনে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং এমপিরা নিজ নিজ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের আÍঘাতী ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে দলীয় ব্যবস্থার অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন করলে ওই নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটসহ আরও ৮টি দল নির্বাচন বর্জন করে। সরকার যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্য নেয়ায় নির্বাচনটি ব্যাপক সন্ত্রাসকবলিত হয়ে পড়ে। জনগণ এ নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। শতকরা ৫ ভাগের মতো ভোট পড়লেও তাঁবেদার নির্বাচন কমিশনের হিসেবে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। সেটি এমন নির্বাচন হয়েছে, যে নির্বাচনকে বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষণযোগ্য পর্যন্ত মনে করেননি।
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য ছিল, ওই নির্বাচনে ভোট গ্রণের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায় যে, কোন দল সরকার গঠন করবে। কারণ ৩০০ আসনের মধ্যে যেখানে সরকার গঠন করতে ১৫১ আসনে জয়ী হতে হয়, সেখানে ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি ভোট গ্রহণের আগেই অটো নির্বাচিত হয়ে যান। ফলে ৪ কোটি ৮০ লক্ষাধিক ভোটার ভোটদানের সুযোগই পাননি। দুটি বড় দলের প্রধান নেতাকে গৃহবন্দি করে রাখলেও ইসি সে ব্যাপারে নীরব ছিল। মনোনয়নপত্র জমাদান ও প্রত্যাহারে আরপিও অনুসৃত হয়নি। নির্বাচনী সিডিউল ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রচারণা শেষ হওয়া পর্যন্ত ১৪৯ জন নিহত, ৪৮৮৬ জন আহত, ১০ জন গুম এবং নির্বাচনের দিন এবং তার পরদিন যথাক্রমে ২৫ ও ৬ জন নিহত হন। প্রতিযোগিতাহীন, প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন এ নির্বাচনে ৫৩১টি ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ১২ হাজার ভোট কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরণ, ১৭ জেলায় ৪শ’ ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত, ৪৮টি ভোট কেন্দ্রে যথাসময়ে নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হয়নি; ৪১টি কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। পিটিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে খুন করার ঘটনাও তখন ঘটেছে।

নোয়াখালী ও চাঁদপুরে নির্বাচনের দিনই নির্বাচন বর্জনকারীরা এ নির্বাচনের কুলখানির আয়োজন করেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩টি আসনের বাইরে বাকি ১৪৭ আসনের মধ্যে ৯০টি আসনের রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারের প্রদত্ত ভোটে নির্বাচনের ৬ মাস পর গরমিল খুঁজে পেয়ে ভোটারসংখ্যা সমন্বয় করার জন্য রিটার্নিং অফিসারদের চিঠি দেয় ইসি। এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় ভোটাররা ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ পাননি। পত্রিকার পাতায় ফাঁকা ভোট কেন্দ্রে কুকুরের শুয়ে থাকার ছবি প্রকাশিত হয়। এই হল দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের নমুনা। এ নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে ঘটেছে নির্বাচনী ব্যবস্থার অধিকতর অবনমন। উপজেলা নির্বাচনের দুই পর্বের পর থেকে ভোটের দিনের কষ্ট লাঘব করার জন্য ভোটের আগের রাতে প্রিসাইডিং অফিসারকে আয়ত্তে নিয়ে কিছু ব্যালট বাক্স আগেই ব্যালটে সিল মেরে ভরে রাখার অপসংস্কৃতি যুক্ত হয়েছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের পর নির্বাচনী দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে।

এখন একাদশ সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসায় আবারও ক্ষমতাসীন জোট ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার মনোবাসনা নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে। যদিও মহাজোট সরকার দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ওই নির্বাচনকে একটি ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করে পরবর্তী সময়ে আরেকটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছিল।
কিন্তু পরে তারা সে ওয়াদা থেকে সরে এসে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের মধ্য দিয়ে দুর্বল সংসদ ও ‘বিরোধীদলেও থাকব এবং মন্ত্রিত্বও করব’ এমন আম ও ছালা দুটোই একসঙ্গে রাখার তথাকথিত বিরোধী দলকে নিয়ে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে দেশে নির্বাচনী সংকট দেখা দেয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে।
বিদেশিরা বারবার ইনক্লুসিভ নির্বাচনের তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও সরকার কারও কথায় কর্ণপাত না করে হামলা-মামলা ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে সরকারি ভাষায় ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখতে চায়। কিন্তু আবারও যদি একগুঁয়েমি করে সরকার দশম সংসদ নির্বাচনের মতো নামকাওয়াস্তে একটি নির্বাচন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে, তাহলে তা সরকারের জন্য যেমন ভালো হবে না, তেমনি দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও মঙ্গলজনক হবে না।
সরকারি শিবির থেকে এখন সংবিধানকে বড় করে দেখিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেখানোর জন্য রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সার্চ কমিটি গঠন করা হলেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সরকার ও শাসক দলের পছন্দমতো নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত হামলা-মামলায় মাঠের প্রধান বিরোধী দলকে কাবু করার চেষ্টা চলমান রয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি মামলার রায়ে জেলে রয়েছেন। পুলিশি হয়রানিতে এ দলের বাকি নেতাদের অনেকেই রাতে বাসায় ঘুমাতে পারছেন না। এ ব্যাপারে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন সরকারামলে নিজদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া হাজার হাজার মামলাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হিসেবে খারিজ করে দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের একই মেরিটযুক্ত মামলাগুলোকে সক্রিয় করে তাদের নাজেহাল করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
এমনই এক অবস্থার মধ্যে সরকারদলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন করতে চায়। সরকারদলীয় নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনে যদি কেউ না আসে তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার। দলীয় তত্ত্বাবধানে যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তাকেই তারা নির্বাচনকালীন সরকার আখ্যা দিয়ে বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে।
আর শেখ হাসিনার সরকারই হবে সে নির্বাচনকালীন সরকার। এমন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচন যে ভালো হবে না, তা তারা একবারও ভাবতে চাইছেন না। তাদের উদ্দেশ্য ছলে-বলে, কলে-কৌশলে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। এমন নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেলে যে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ, সে কথা তাদের মাথায় আসছে না। এ ব্যাপারে তারা কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনায়ও রাজি হচ্ছে না।

বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হলে সে আবেদনে সাড়া না দিয়ে সরকার ও সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীরা ঘনঘন ভারত সফর করছেন। তারা একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চান। তারা ভুলে গেছেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারণ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যে কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভের প্রথম এবং প্রধান স্তম্ভটি ছিল গণতন্ত্র। আজ সে গণতন্ত্র অসুস্থ। উন্নয়নের নামে গণতন্ত্র সম্ভবত ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই।
যুদ্ধক্ষেত্রে বিবদমান শত্রু পক্ষের মধ্যেও যদি আলাপ-আলোচনা হতে পারে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে সরকারি দলের অন্য বড় দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে অনীহা কেন? তারা হয়তো ভাবছেন, আলোচনা এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ওই নির্বাচনে জিতলেই তাদের লক্ষ্য হাসিল হবে। কিন্তু ব্যাপারটি কি এতই সোজা! এখানে নির্বাচনকালীন সরকার থাকলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না।
সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় তো একটি নির্বাচনকালীন সরকার থাকেই। তাই বলে কি সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়? মূল কথা হল, নির্বাচনকালীন সরকারটি ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ারের মতো নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে কিনা? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রী, এমপি ও দুই নৌকায় পা দেয়া কিছু বিরোধীদলীয় নেতাকে নিয়ে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে যে সংসদ নির্বাচন কতটা ভালো হবে তা নাগরিক সমাজ দশম সংসদ ও পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর চরিত্র দেখে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। এ জন্য তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকারের এমন দুরভিসন্ধি পছন্দ করবে না।
আর শক্তি প্রয়োগ করে গায়ের জোরে সবাইকে দমন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করা হলে, তা জাতির জন্য আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এমন হলে দেশ কেবল গণতান্ত্রিক বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়বে না, দেশের সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়ে স্তিমিত জঙ্গিবাদী তৎপরতাও বৃদ্ধি পেতে পারে।

তবে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের এখনও সময় আছে। দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা সরকারকে অনুরোধ করব, আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করুন। মনে রাখবেন, সংবিধান মানুষের জন্য। তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার জন্য। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংশোধন করে দেশ বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। গণতন্ত্রকে কার্যকর করুন। মানুষকে বাঁচান। দেশের মানুষকে মানসিক শান্তি দিন। কাজেই সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের সর্বসম্মত রূপরেখা ঠিক করে ওই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিন। তাহলে দেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে এবং ভোটারদের মধ্যে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/48490